ভারতের হাসিনা দ্বিধা: হাসিনা এখন শিরঃপীড়া?
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল মঈন খান বলেন, “ভারত একমাত্র আওয়ামী লীগ ও এর সরকারকেই মিত্র ভাবে। তাদের জন্য এটি একটি কৌশলগত ভুল।”
শেখ হাসিনার বিদায়ের প্রায় এক মাস হতে চলল। তিনি এখনো ভারতেই আছেন। গেল ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের দিল্লির এক সামরিক ঘাটিতে অবতরণ করেন তিনি।
শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল- তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ভারতে অবস্থান করবেন। গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত, সৌদি আরব বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোথাও থেকে ইতিবাচক সাড়া পাননি তিনি।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা এবং দেশকে এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে যান।
ভারতে শেখ হাসিনার এ দীর্ঘ অবস্থান- দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্কের মধ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ভারতের জন্য বাংলাদেশ শুধু একটি প্রতিবেশী দেশ নয়। বাংলাদেশ তাদের কৌশলগত অংশীদার, এবং ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুই দেশের মধ্যে চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে, রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সহজেই এসব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর- ভারত সম্মিলিতভাবে কিছু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধগুলোও শেখ হাসিনা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মীমাংসা করেছিলেন।
সীমান্ত নিরাপত্তা সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলেও, এর কিছু আর্থিক দিকও রয়েছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহণের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সড়ক, নৌ ও রেল সহযোগিতা পেয়েছে।
২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভারত ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
শেখ হাসিনার অবর্তমানে ভারতের এসব অর্জনগুলো রক্ষায় দিল্লির আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “যেকোনো প্রতিবেশী দেশের বিশৃঙ্খলা সবসময়ই অনাকাঙ্ক্ষিত।”
কিন্তু সাবেক এ কূটনীতিক জোর দিয়ে বলেন, দিল্লি ঢাকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। কারণ তাদের কোনো ‘বিকল্প নেই’ এবং ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কোনো নির্দেশ দিতে পারে না’।
ভারত সরকারও ঢাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কালক্ষেপণ করেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
তবে গত ১৫ বছর শেখ হাসিনা ও তার দলকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। এ ক্ষোভ প্রশমিত করতে ভারতের কিছুটা সময় লাগবে। অনেক বাংলাদেশি মনে করেন, পর পর তিন নির্বাচনে ভোটে জালিয়াতি করে জয়ী শেখ হাসিনাকে ভারত দ্রুত সমর্থন দেওয়ায় এ ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি ধাক্কা খায়। কারণ ভারতের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ দেয় মালদ্বীপ ও নেপাল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত নিজের আঞ্চলিক শক্তি বজায় রাখতে প্রতিবেশী দেশের ওপর তার প্রভাব হারাতে চাইবে না। কারণ একই আঞ্চলিক শক্তির জন্য চীন লড়াই করছে। গত বছরই ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন মোহামেদ মউজ্জু।
ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “এবার আঞ্চলিক নীতি বিষয়ে ভারতের নিজের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয়েছে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির জন্য গঠিত কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া দেবপ্রিয় আরও বলেন, “ভারতের নীতি আঞ্চলিক অংশীদাররা যথাযথভাবে গ্রহণ করছে কিনা তা দিল্লির দেখতে হবে। আর আমি শুধু বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছি না। বরং এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশের জন্যই বিষয়টি প্রযোজ্য।”
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন ভারতীয় কোনো সরকার বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল মঈন খান বলেন, “ভারত একমাত্র আওয়ামী লীগ ও এর সরকারকেই মিত্র ভাবে। তাদের জন্য এটি কৌশলগত একটি ভুল।”
যদি সামনে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপির নেতারা বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী বলে জানান তিনি।
তবে নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে দিল্লির জন্য একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। কারণ দুই মেয়াদে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে দৃশ্যমান ঘাটতি ছিল।
শেখ হাসিনার আমলে ২০১৮ সাল থেকে বেশিরভাগ সময় জেলে, ও তারপরে একপ্রকার গৃহবন্দি হয়ে কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করেছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি কারাদণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
আগামী দিনগুলোতে ভারত ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান ঘাটতিগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায় বের করতে হবে দিল্লির। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এসময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আসা বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে দিল্লি। এছাড়া, বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা অভিযোগ করেন, ২০০১ সালে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাদের জোটের ইসলামপন্থি দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুট ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতন চালায়। যদিও এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে বিএনপি।
আব্দুল মঈন খানসহ বিএনপির আরো নেতারা বলেন, ভারত কখনোই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসেনি। এখন দিল্লির এ নীতি পরিবর্তনের সময় এসেছে।
মঈন খান বলেন, ভারতের নৈকট্য, আকার এবং এর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বিবেচনায় রেখে তার দল ভারতবিরোধী কোনো বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়ে ভুল করবে না।
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের আরো কিছু কারণ রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ ৫৪টি নদী সম্পর্কিত পানিবণ্টন বিষয়ক বিতর্ক রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যা দুটি দেশের মধ্যে ভুল তথ্যের কারণে যে ফাটল ধরাতে পারে তার একটি উদাহরণ এটি।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হঠাৎ ভারী বৃষ্টির কারণে অতিরিক্ত পানি গোমতী নদীতে প্রবাহিত হয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। যার ফলে রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেকেই তাদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি এবং ফসলি জমি হারিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে অনেক গ্রামবাসী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ভারতকে দায়ী করেছেন। তারা অভিযোগ করেন, ভারত তাদের বাঁধ খুলে দেওয়ায় এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। যেখানে তারা ব্যাখ্যা করে বলেন, গোমতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এই বন্যা হয়েছে।
ভারতের প্রতি ক্ষোভের আরও একটি কারণ হলো চীন। আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ে ভারতকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ আছে।
মালদ্বীপের নির্বাচনে জয়লাভের পর মুইজ্জু যখন তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য চীনে যান, তখন বেইজিং তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা জানায়।
মালদ্বীপের সঙ্গে ভারত যে পরিস্থিতিতে পড়েছে- সেই একই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সঙ্গে এড়াতে চাইবে ভারত। তারা আশা করে, ভারতীয় পণ্য ও বাণিজ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতার কারণে কূটনৈতিক কৌশল ঠিক করতে কিছুটা সময় পাবে নয়াদিল্লি।
তাই দিল্লিকে শেখ হাসিনার ভারতের উপস্থিতি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর বিশেষ করে নতুন সরকার যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করে, সে বিষয়েও ভারতকে ভাবতে হবে।
গত মাসে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু ভারত শেখ হাসিনাকে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকা অবস্থায় দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা বলতে চাইবে না এবং একটি শক্তিশালী সাবেক মিত্রকে বিপদের মধ্যে ফেলে আসার মতো ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইবে না ভারত।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয় ভারতকে সতর্ক করে বলেন, “ভারতে শেখ হাসিনাকে কীভাবে আতিথ্য দেওয়া হয় তা গুরুত্বপূর্ণ না। বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শেখ হাসিনা সেখানে বসে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করছেন কিনা। যদি তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন তাহলে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হবেন।”
ভারতীয় কূটনীতিকরা তাই আশা করেন, শেখ হাসিনা কোনো চাপ ছাড়াই নিজের জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেবেন।