ভারত কেন ব্রিটেনে টন টন সোনা রেখেছিল, ফেরতই বা আনছে কেন
ভারতে এখন সোনাকে ঘিরে চলছে নানা আলোচনা। শুধু নারীরাই নন, সোনা নিয়ে চিন্তিত দেশটির সবাই। বিয়ের মৌসুমে সোনার দাম বাড়লে রাতের ঘুম ছুটে যায় বাড়ির কর্তাদের। তবে গোটা দেশে এখন আলোচনা হচ্ছে টন টন সোনা নিয়ে।
ইংল্যান্ড থেকে ১০০ টনের বেশি সোনা গেছে ভারতে।
শাসনকালে রাশি রাশি সোনা নিয়ে ভারত থেকে ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছিলেন ইংরেজরা। ১৯০ বছরের পরাধীনতায় ভারত ঠিক কত পরিমাণ সোনা হারিয়েছে, খাতা-কলমে তার হিসাব নেই। সেই ইংরেজদের দেশ থেকে সোনা ফিরিয়ে আনার খবর সাধারণ মানুষের মনেও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ইংরেজদের নিয়ে যাওয়া সোনাই ভারত ফিরিয়ে আনছে? উত্তর হলো, না। ভারতের জমা রাখা সোনাই ভারত ফিরিয়ে আনছে। যা থাকবে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ভল্টে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০০ মেট্রিক টন সোনা বিদেশ থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে মাটির নিচে থাকা ৯টি বড় বড় ভল্টে থাক থাক করে সাজানো থাকে সোনার বার। শুধু ভারতের নয়, বিভিন্ন দেশের সোনা ওই ভল্টে জমা রয়েছে। কেউ চাইলেই ওই ভল্টে যেতে পারেন না। একমাত্র ইংল্যান্ডের রাজা বা রানিই ওই ভল্টে যেতে পারেন এবং জমা সোনা দেখতে পারেন।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মধ্যে এক ভীতি জন্ম নিয়েছিল।
ধারণা হয়েছিল, ভারতের বাজারে যদি কোনো বিদেশি কম্পানিকে ব্যবসা করতে দেওয়া হয়, তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মতোই অবস্থা ঘটতে পারে। তাই ভারতের বাজার সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। যা ধীরে ধীরে ভারতকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
একদিকে ভারতীয় বাজারে বিদেশি সংস্থার ‘নো এন্ট্রি’, অন্যদিকে বিদেশ থেকে বিভিন্ন জিনিস আমদানির কারণে ভারতের আর্থিক ভাণ্ডারে টান পড়তে শুরু করে। রপ্তানির থেকে আমদানির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। ভারত বিদেশ থেকে মূলত তেল আমদানি করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেই এই কারবার চালায় ভারত। ১৯৯১ সালের আগে ভারতে প্রয়োজনীয় তেলের বেশির ভাগ জোগান আসত ইরাক থেকে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চোখ-রাঙানি।
সব মিলিয়ে তেলের দাম হু হু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারতে তেলের সংকট দেখা দেয়। তেল কিনতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত ডলারের। কারণে বিদেশে ভারতের টাকা চলে না। কিভাবে ডলার পাওয়া যাবে তার পথ খুঁজতে থাকে তৎকালীন সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ডলার নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ভারতের। কিন্তু সেখান থেকে ডলার নিতে গেলে মেনে চলতে হতো তাদের দেওয়া শর্ত। অনেকের মতে, আইএমএফ হোক বা বিশ্বব্যাংক, নামে স্বতন্ত্র হলেও তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রই ছড়ি ঘোরায়।
ভারত সে সময় বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। তখনই সোনা বিদেশি ব্যাংকে রাখার পরিকল্পনা মাথায় আসে সরকারের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এড়িয়ে সোনা অন্য কোনো বিদেশি ব্যাংকে জমা রাখাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। শোনা যায়, গোপনে সোনা ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এবং ব্যাংক অব জাপানের কাছে জমা রাখে ভারত। তার বিনিময়ে ডলার নেয়। এই পুরো অপারেশনটা ভারত সরকার গোপনে করার চেষ্টা করলেও কয়েকটি সংবাদপত্রে তা ফাঁস হয়ে যায়। এবার বিদেশে জমা রাখা সোনাই ভারতে ফেরানো শুরু হয়েছে।
ভারতের কাছে এখন সোনা রয়েছে ৮২২ মেট্রিক টন। বিগত পাঁচ বছরে ভারত ২০৩.৯ মেট্রিক টন সোনা কিনেছে। তার মধ্যে কিছু মজুদ রয়েছে আরবিআইয়ের কাছে। কিছু বিদেশি ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। শুধু ডলারের বিনিময়ে সোনা বিদেশি ব্যাংকে জমা পড়ত তা-ই নয়। ভারত এমনি সময়েও সোনা বিদেশে রাখে। দেশের মধ্যে বিভিন্ন অস্থিরতার কথা চিন্তা করেই সরকার দেশ থেকে সোনা সরিয়ে রাখে।
তাহলে ভারত কেন সোনা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হলো? রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশই ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার ফলে বিদেশি ব্যাংকে রাশিয়ার জমা রাখা সম্পদ ‘ক্লোজড’ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।