Hot

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিঃসঙ্গ মানুষ, বাড়াচ্ছে আত্মহত্যা: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়

সম্প্রতি রাজধানীর এক রেস্টুরেন্টে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহিদুলের সঙ্গে দেখা হয় সামির। তারা দু’জনেই সিলেট সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী এবং ভালো বন্ধু। সামি ৩ বছর আগে কানাডা চলে যায় আর শহিদুল ঢাকায়। তাদের দেখা হওয়ার পর ১০-১৫ মিনিট গল্প গুজব ও আড্ডার পর দুজনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে যান। এরপর তারা ১ ঘণ্টা আড্ডা দিলেও বেশিরভাগ সময় মন ছিল মোবাইলের দিকে।

এটা কেবল সামি কিংবা শহিদুলের ক্ষেত্রেই নয়। বর্তমান বাস্তবতায় মানুষ ভার্চুয়াল জগতে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন, তাদের যোগাযোগ সব ভার্চুয়াল জগতকে কেন্দ্র করে। খেলার মাঠ নেই, আড্ডার জায়গা নেই ফলে তরুণদের অবসর কাটে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রামে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, প্রতিযোগিতা ও সামাজিক বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ভার্চুয়াল নাগরিকে পরিণত করছে। ফলে তারা মনের অজান্তে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নিঃসঙ্গতা আত্মহত্যার একটা বড় কারণ। সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় যারা পিছিয়ে যায়, তারা জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। সময়মতো চাকরি না পাওয়া, আবার পেলেও সমাজ ও পরিবারের চাহিদা পূরণ না হওয়াও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। যারা ক্যারিয়ারের শীর্ষে ওঠে তাদের প্রতিযোগিতা থামে না; বরং আরও বেড়ে যায়। প্রেমঘটিত কারণেও আত্মহত্যা বাড়ছে।

তারা বলেন, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে মানসিক রোগ বেশি। যদিও মানসিক রোগে ভুগতে থাকা ৯২-৯৪ শতাংশই রয়েছে চিকিৎসার বাইরে। মানসিক রোগের চিকিৎসা নিলে সমাজ বিষয়টি নেতিবাচকভাবে নেবে এমন ভয়ে পরিবারের সদস্যরা চান না সমস্যায় থাকা ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাতুল জামান সম্প্রতি সুইসাইড করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদকে মেনে নিতে পারিনি। ৩ বছরের প্রেম শেষে সে অন্য একজনের দিকে আকৃষ্ট হয় ফলে প্রচণ্ড হতাশা থেকে আত্মহত্যা করতে হারপিক খাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তীব্র গন্ধে বমি পায়, আম্মু বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন এবং আমাকে নিবৃত্ত করেন।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আবির আহমেদ সিলেটের একটা কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেম করে বিয়ে করলেও দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। বাবা মা আগেই মারা গিয়েছেন, ভাইরা চাকরী ও নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে স্ত্রীর সঙ্গে নানা কারণে বনিবনা হচ্ছে না। ফলে সিগারেট খাওয়া শুরু করি। প্রচণ্ড হতাশায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে অনেকগুলো ওষুধ খেয়ে ফেলি। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, কলেজে যাইনি, ফোন ধরিনি এ থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে সন্ধ্যায় এক সহকর্মী আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফলে রক্ষা পাই।

আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পারিবারিক, সম্পর্কজনিত, আর্থিক টানাপড়েন, পড়াশোনা এবং বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। এই সময়ে সর্বাধিক ৩৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে বিভিন্ন পারিবারিক কারণে, এরপরই ২৪ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে সম্পর্ক ও আর্থিক ও লেখাপড়াজনিত কারণে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব আত্মহত্যার পেছনেই আত্মহত্যাকালীন ব্যক্তির মানসিক অবস্থার অবনতি ছিল। বিষন্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া, মুড ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগে ভুগছিল। আর এ কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। এ ছাড়া এই রোগগুলোর প্রতি একধরনের বদনাম জড়িয়ে আছে, ফলে সংকোচের কারণে অনেকেই এগুলোর চিকিৎসা করাতে সচেষ্ট হয় না, উৎসাহিত হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে মানুষ আরও বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে যারা মানসিক রোগে ভুগছে এর মধ্যে ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে রয়েছে। দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) ৩৫০, মনোবিজ্ঞানী (সাইকোলজিস্ট) ৫ শতাধিক, এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মানসিক স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসার বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে।’

আত্মহত্যায় মৃত্যু নিয়ে দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে ধারাবাহিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গবেষণা হয়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন ও বছরে ১০ হাজার ২০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। এর ৭ বছর পর আঁচল ফাউন্ডেশন আত্মহত্যা নিয়ে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ এক বছরে আত্মহত্যা করে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এই সময়ে দিনে গড়ে আত্মহত্যা করে প্রায় ৪০ জন করে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয় প্রায় ১৩ হাজার মানুষের।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button