ভুতুড়ে সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা হতবাক

নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি যেখানে দাম কমানো যায় সেখানে বাড়ানো হয়েছে : ড. শামসুল আলম গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয় দাম কমানো উচিত : শওকত আজিজ রাসেল বিনিয়োগকারীদের পোষালে বিনিয়োগ করবে না পোষালে নয় : জালাল আহমেদ নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণের নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি
একটি এফএম রেডিওতে সপ্তাহে একদিন ভূতের গল্প শোনানোর অনুষ্ঠান হয়। গল্পে দাবি করা হয় পৃথিবীতে ভূত আছে এবং সে ভূত পেছনের দিকে হাঁটে। পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু আছে কি না জানা নেই। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ভুতুড়ে কা- ঘটেছে। দেশে যখন বিনিয়োগে খরা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন নতুন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’ আয়োজন করা হলো। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইউএইসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪২টি দেশের বাংলাদেশসহ ছয় শ’র অধিক খ্যাতনামা বিনিয়োগকারী অংশ নেন। সম্মেলনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জানান, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সনদপত্র পেতে ভোগান্তি, আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় এনবিআরের অসহযোগিতা, উৎপাদন খরচ বেশি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপর্যাপ্ততা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতি বড় বাধা। ড. ইউনূস যে দেশেই যাচ্ছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। তখন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ভুতুড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নতুন বিনিয়োগকারী তথা নতুন শিল্পে গ্যাসের ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হলো। এমনকি পুরনো শিল্পে বাড়তি উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহারে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ, শিল্পোদ্যক্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যত আত্মঘাতী। সরকার যখন নতুন বিনিয়োগের লক্ষ্যে হন্যে হয়ে উদ্যোক্তা খুঁজছে তখন গ্যাসের দাম বেশি শুনলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে পুরনো এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এটি সরকারের নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণের নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। গত বিনিয়োগ সম্মেলনে সরকার যেখানে বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে, সেখানে এখন কীভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়? আমিসহ অনেক বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু এখন এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে সবাইকে তা পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে, কারণ এতে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ছিল ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। এটি বেড়ে করা হয়েছে ৪২ টাকা। আর শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা। নতুন এ দাম ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। দেখা যাচ্ছে নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ। প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে তাদের। পুরনো শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহারে দিতে হবে বাড়তি দাম। প্রতিশ্রুত শিল্প গ্রাহকদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি দাম দিতে হবে।
জানা গেছে, আস্থাহীনতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত তিন বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসেবে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশে প্রবৃদ্ধির ধীরগতির মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অর্থনীতির জন্য আরেক বড় ধাক্কা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগে আস্থাশীল হতে পারছেন না। তাদের বক্তব্য নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে তখন বিনিয়োগে ভীতি দূর হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজের ক্যারিশমা কাজে লাগিয়ে দেশি- বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন নতুন বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন। অথচ নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে কা-জ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েছেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নতুন বিনিয়োগ কমার বিষয়টি এখনই বলা যাবে না। নতুন বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে কি না তা নজরে রাখা হবে। নতুন যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে, তারা যদি দেখে তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবে। তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারে’। নতুন ও পুরনো শিল্পে আলাদা দাম রেখে যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, এটা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি না; এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসির আইনি আওতার মধ্য থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ¦ালানি উপদেষ্টা প্রফেসর শামসুল আলম বলেন, জ¦ালানি খাত পরিচালনায় আগের সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাম না বাড়িয়ে বিগত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে সমন্বয়কৃত লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের সর্বমোট পরিমাণ আগে নির্ধারণ করতে হবে এবং বিদ্যমান মূল্যহারে সমন্বয়কৃত লুণ্ঠনমূলক ব্যয় কমিয়ে মূল্যহার কমাতে হবে, জ্বালানি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য বিইআরসি আইন সংস্কার করতে হবে।
গণশুনানিতে আমরা হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছি দাম কমানো যায়। বিগত সরকার যেসব লুন্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে, দাম বাড়ানো হলে ভোক্তাদের সুরক্ষা না দিয়ে সেই লুন্ঠনমূলক ব্যয়ের অভিযোগের দায়ভার তারা কাঁধে তুলে নিলেন বলে প্রমাণিত হবে।
গতকালও বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানিয়েছেন, বিনিয়োগ সম্মেলনে ৩১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ফ্যাক্টরি ভিজিট করিয়েছি। ফ্যাক্টরি করতে হলে কোথায় যেতে হবে, তাদের দেখানো হয়েছে। সম্মেলনে এসে বিনিয়োগকারীরা খুব খুশি হয়েছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গ্যাস মজুদ রয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনো নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নেয়নি। এর পরিবর্তে তারা এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা মূলত একটি অলিগার্ক শ্রেণিকে লাভবান করেছে। এটি ছিল পূর্ববর্তী সরকারের অনুসৃত পথ। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি দেশের শিল্প খাতকে ধ্বংস হতে দেবে, নাকি এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? যেকোনো পরিস্থিতিতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং, এখন দাম কমিয়ে ২০ টাকার কাছাকাছি আনা উচিত। বিপিসি, তিতাস এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে উপকার পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তা বা শিল্পখাত।