Bangladesh

ভূমিকম্প মোকাবিলার সক্ষমতা কম

ঝড়-বন্যার বাংলাদেশ এখন আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মুখে। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিরতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পে। এর অনেকগুলোর উৎপত্তিস্থলও দেশের ভেতরে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে দেশেও হতে পারে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। আর তেমন কোনো ঘটনা ঘটলে দেশের পরিস্থিতি কী হবে তা কল্পনাও করতে পারেন না তারা। কারণ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তার সিকি ভাগও নেই ভূমিকম্প মোকাবিলায়।

এমন প্রেক্ষাপট আজ ১০ মার্চ পালিত হচ্ছে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘দুর্যোগ প্রস্তুতি লড়ব, স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ব’।

দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ২০৪১ সালের মধ্যে দুর্যোগ সহনশীল, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ছোট আকারের ভূমিকম্প বেড়েছে। গত ১৪ মাসে ১২টি ভূমিকম্প হয়েছে। যেগুলো ছিল মৃদু থেকে মাঝারি আকারের। ভূতত্ত্ববিদরা বলে আসছেন, ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট। তবে উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আয়তন অনুযায়ী অধিক জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবেই এ ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়েছে।

গত ২০ বছরে ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলেও একাধিক ছোট ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।

ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল আগারগাঁও থেকে ৯ কিলোমিটারের মধ্যে। সেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ১০ কিলোমিটার গভীরে। ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই ময়মনসিংহে ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল ১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীরে। ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে উৎপত্তি হওয়া ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল ১৬ কিলোমিটার গভীরে। ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ছিল আগারগাঁও থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আগারগাঁও থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরের টাঙ্গাইলে উৎপত্তি হয়েছিল ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প।

এ ছাড়া ২০২৩ সালে ঢাকার আশপাশে ৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষ গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয় রাজধানী ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। এর আগে একই বছর ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৪ মাত্রার। অন্যটি ৫ মে ঢাকা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দোহারের কাছে উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৪ দশমিক ৩ মাত্রার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি প্লেটের বাউন্ডারিতে অনেক বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। আমরা এই প্লেট বাউন্ডারির পূর্ব থেকে ১০০-২০০ কিলোমিটার দূরে। যেহেতু আমরা প্লেট বাউন্ডারির কাছে ফলে ভূমিকম্প হওয়াই স্বাভাবিক।’

তিনি বলেন, যেখানে প্লেট বাউন্ডারি আছে, প্লেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক চ্যুতি বা ফাটল আছে। এসব চ্যুতি ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ঢাকার আশপাশেও চ্যুতি রয়েছে। এই চ্যুতিতে যদি ২০০ বছর অথবা ৫০০ বছর আগে ভূমিকম্প হয়ে থাকে, তবে এখানে আবার ভূমিকম্প হবে এটাই নিয়ম। অর্থাৎ আগে এ অঞ্চলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ওই ভূমিকম্প আবার হবেই, এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ হচ্ছে যেখানে ভূমিকম্প হয়, সেখানে শক্তি সঞ্চার হয়। এই শক্তিটা যখন ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়, তার আশপাশের পাথর, মাটি একপর্যায়ে ভেঙে যাবে। ভেঙে গিয়ে যদি বিচ্যুত হয়ে যায়, তখনই বিপর্যয় ঘটে।

ঢাকা সব সময় ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে বড়মাত্রার ভূমিকম্প হয় না। তবে অতীতে হয়েছে। যেগুলো হয়েছে তাতে ক্ষতি তেমন হয়নি। শুধু ১৮৯৭ সালে যে ভূমিকম্পটা হয়েছে, তাতে ঢাকা শহরের কিছু ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। যদিও ক্ষতি ছিল কম। তবে ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই ধরনের ভূমিকম্প হলে এখন ঢাকা শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।

কতটা ঝুঁকিতে রাজধানী : কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে শুরু হয় তোড়জোড়। করা হয় তদন্ত কমিটি। কোথাও কোথাও নেওয়া হয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। তবে তা কিছুদিনের মধ্যে ধামাচাপা পড়ে যায় আরেকটি বড় দুর্ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত। সম্প্রতি বেইলি রোডে অগ্নি দুর্ঘটনার পর রাজধানীর ভবন নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ৯৪ ভাগ ভবনই অননুমোদিত। এর মধ্যে বেশিরভাগই ঝুঁকিতে রয়েছে। রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে একেক ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে এক জরিপের বরাত দিয়ে রাজউক জানিয়েছিল, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রায় ৭২ হাজার। ২০১৬ সালের ১৭ মে ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান জানিয়েছিলেন, নগরীতে ১১০ ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৮ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছিলেন, রাজধানীতে ৩২১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে সরকারের সহযোগী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে সমন্বিত কারিগরি জরিপ করা দরকার। না হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং এর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, যেসব দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়, তাদের উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, সে তুলনায় বাংলাদের অবস্থান জিরো। কারণ ঢাকা শহরের দিকে তাকালে খালি চোখেই দেখা যায়, কীভাবে অপরিকল্পিতভাবে ভবন ও বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। দুটো ভবন উদ্ধারের সক্ষমতা নেই। এ ছাড়া বিপর্যয় ঘটলে মানুষ খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াবে তারও কোনো সুযোগ নেই।

স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এ মুহূর্তে ভূমিকম্প হলে কারোর কিছুই করার থাকবে না। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করতে হলে আমরা যে বারবার দাবি করছি জরুরি ভিত্তিতে সমীক্ষা করে প্রতিটি ভবন অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। কারণ ৯৪ শতাংশ ভবন অননুমোদিত। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্লিডিং কোড অনুসারে ভবন নির্মাণ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ঢাকা শহরে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গেলে সবচেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয় সরু রাস্তার কারণে। প্রণোদনা দিয়ে হোক অথবা একীভূত করার মাধ্যমে রাস্তাগুলো কমপক্ষে ৬ মিটার চওড়া করতেই হবে। সেই সঙ্গে ঘনবসতির এই নগরীতে হাইড্রেন্ট বসানোর বিষয়টা জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। এ ছাড়া মাটির নিচে যে গ্যাসের লাইন রয়েছে, কোনো কারণে ভূমিকম্প হলে আর গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটলে ভূমিকম্পের চেয়ে ভয়ংকর অগ্নিকান্ড ঘটবে। সেজন্য এসব লাইনের ক্ষেত্রেও যথাযথ পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d