International

ভেঙ্গে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দিরের উদ্বোধন করলেন মোদী

বহু বিতর্কের মাঝেই ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে করা রামমন্দিরে বিগ্রহের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটা ভারতের সব থেকে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলোর অন্যতম। ওখানেই একসময়ে ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ।

রাম মন্দির ধ্বংস করে ওই মসজিদ গড়া হয়েছিল, এই দাবি তুলে উগ্র কিছু হিন্দু জনতা ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙে দিয়েছিল। তারপর সারা দেশে শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার মানুষ।

সোমবার (২২ জানুয়ারি) রামমন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন দেশ-বিদেশের অতিথিরা- যাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে শিল্পপতি, খেলা ও চিত্রজগতের তারকারাও ছিলেন।

যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ এবং বিরোধী দলগুলোর নেতাদের প্রায় সবাই এই অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন এই অভিযোগ তুলে যে নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য একে ব্যবহার করছেন।

ভারতে কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, মন্দিরের নামে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।

২০১৯ সালে অযোধ্যা মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটি একটি ট্রাস্টকে দেয়া যেতে পারে এবং সেখানে একটি রামমন্দির তৈরি করা যেতে পারে।

একইভাবে, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বলা হয় যে তাদেরকে পাঁচ একর জমি দেয়া হবে, যেখানে তারা একটি মসজিদ তৈরি করতে পারবে।

রামমন্দিরের নির্মাণ কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়। যদিও মসজিদের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

সেজে উঠেছে অযোধ্যা
রামমন্দির উদ্বোধনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে আরো কয়েকদিন আগে থেকে। রোববার থেকেই বিখ্যাত সব অতিথিরা প্রাচীন এই নগরে আসতে শুরু করেন।

তবে সোমবার সকাল থেকেই ‘রাম নগরীতে’ সাজো সাজো রব। রাম মন্দির সেজে উঠেছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা আড়াই হাজার কুইন্টাল ফুল দিয়ে। কড়া সুরক্ষা বলয়ে ঢাকা ছিল অযোধ্যা।

কড়া নজর রেখেছেন পুলিশ এবং কমান্ডো বাহিনীর জওয়ানেরা, গতিবিধির উপর নজর রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে স্নাইপারও। উড়ছে অত্যাধুনিক নজরদারি ড্রোন। নিরাপত্তার মোটা চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে পুরো এলাকাকে।

শুধুমাত্র মন্দির নির্মাণের জন্য আনুমানিক ১৮০০ কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে। এর প্রাঙ্গণটি ৭০ একর জুড়ে বিস্তৃত, মূল মন্দির রয়েছে ৭.২ একর জায়গা জুড়ে।

মনোরম তিন তলা মন্দির গড়া হয়েছে গোলাপি বেলেপাথর দিয়ে, নিচের দিকে রয়েছে কালো গ্রানাইট পাথর। প্রায় ৭০ হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথর পাতা হয়েছে। মার্বেল পাথরের বেদিতে বসানো হবে ৫১ ইঞ্চি উঁচু রামের মূর্তি।

অভিজিৎ ক্ষণ
দুপুর ১২টা ২৯ মিনিট ৮ সেকেন্ড থেকে ১২টা ৩০ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের মধ্যে গুনে গুনে ঠিক ৮৪ সেকেন্ড, এই সময়ের মধ্যেই বিগ্রহের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন নরেন্দ্র মোদি। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী একে বলে ‘অভিজিৎ মুহূর্ত’। এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে হিন্দু শাস্ত্রে।

হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, ভগবান রাম এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সারা দিনে দু’বার ‘অভিজিৎ মুহূর্ত’ আসে। শ্রীকৃষ্ণেরও জন্ম হয়েছিল মধ্যরাতের ‘অভিজিৎ মুহূর্তে’। জ্যোতিষশাস্ত্র বলে, সারা দিনে ৩০টি মুহূর্ত রয়েছে। তার মধ্যে ‘অভিজিৎ মুহূর্ত’ অষ্টম।

রামমন্দির উদ্বোধনের পর রামলালার ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ জন্য এই ৮৪ সেকেন্ড নির্ধারিত করা হয়েছিল। সেই নির্ঘণ্ট মেনে এদিন দুপুর ১২টা ৫ মিনিট থেকে চূড়ান্ত অনুষ্ঠান শুরু হয়।

পুরো অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘বহু শতাব্দী ধরে অপেক্ষার পরে ভগবান রাম আবার আমাদের মাঝে এসেছেন। রামলালা আর অস্থায়ী গৃহে নয়, এবার দিব্য মন্দিরে থাকবেন।’

রামমন্দির উদ্বোধনের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামদাস আটাওয়ালে বলেছেন, ‘এটি একটি আনন্দের দিন। সারা বিশ্বের মানুষ প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন।’

এই অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক রঙে রাঙাতে নারাজ তিনি।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুপ্রিয়া প্যাটেল উপস্থিত ছিলেন এদিন অযোধ্যাতে। তিনি বলেছেন, ‘কোনো দেশ নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা না করে উন্নতি করতে পারে না।’

‘প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে আমাদের সরকার আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে এবং আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করার জন্য ক্রমাগত অনুপ্রাণিত করছে,’ মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া বলেছেন, ‘আজ মোদির পূজা দেয়ার ঈশ্বরপ্রদত্ত সুযোগ।’

অনুষ্ঠানে যাননি বিরোধী নেতারা
রামমন্দিরের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীদেরও। কেউ নিমন্ত্রণ ‘রক্ষা’ করতে পারবেন না আগেই জানিয়েছিলেন, কেউবা প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বার্থে ‘মেরুকরণের’ অভিযোগ তোলেন।

এই তালিকায় রয়েছেন সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব। তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, ২২ জানুয়ারি তার পক্ষে অযোধ্যা যাওয়া সম্ভব নয়, পরে অন্য কোনো সময় তিনি মন্দিরে যাবেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, রামমন্দিরে যাওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন নেই। হৃদয়ে রয়েছেন রাম।’

একই তালিকায় রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও।

এদিন ‘সংহতি মিছিলের’ ডাক দিয়েছিলেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছিলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমি সর্বধর্ম সমন্বয়ের মিছিল করছি। সেখানে থাকবেন সমস্ত ধর্মের মানুষ। তাদের প্রত্যেককে শ্রদ্ধা জানিয়ে হবে আমাদের কর্মসূচি।’

এই কর্মসূচিতে ইতোমধ্যে বাউল, মুর্শিদী ও ফকিরি গানের একাধিক গোষ্ঠী ও শিল্পীও অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন। থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ সনাতন ব্রাহ্মণ ট্রাস্টের সদস্যরা।

এই সংহতি মিছিলের প্রাক্কালে রোকবার নিজের এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি বার্তায় দিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। তিনি লিখেছেন, ‘মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার যা-ই হোক, ঘৃণা, সহিংসতা ও নিরীহ মানুষের লাশের উপর তৈরি কোনো উপাসনাস্থল মেনে নিতে আমার ধর্ম আমায় শেখায়নি।’

অন্যদিকে, ২২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা স্কুল, কলেজ এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে হাফ ছুটির ঘোষণাকে ঘিরে আগেই আলোচনা চলছিল।

এরপর রামমন্দিরের অনুষ্ঠান ‘লাইভ সম্প্রচারকে’ ঘিরে আবার বিতর্ক শুরু হয়।

তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকার রামমন্দিরের অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচারে সম্মতি দেয়নি।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভারতে বিজেপি যেখানে ক্ষমতায় নেই, এমন রাজ্যগুলো ২২ জানুয়ারি রামমন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণার আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে একটি ‘‌সামাজিক উৎসব’‌ হিসেবে দেখার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে কলকাতার নাখোদা মসজিদ কর্তৃপক্ষ।

এই উৎসব নিয়ে নাখোদা মসজিদ কর্তৃপক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করেছেন, এই অনুষ্ঠান নিয়ে যেন কোনো খারাপ মন্তব্য এবং বিরোধিতা যেন না করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button