Bangladesh

ভেজালে সয়লাব বাজার

পরীক্ষাগারে পণ্যের অভাব ♦ মাসে গড়ে পরীক্ষা ৩২ ♦ খাদ্য পরিদর্শকরা ব্যস্ত মশা মারার কাজে ♦ আইনি জটিলতায়ও বাধা

ভেজাল পণ্যে সয়লাব বাজার। মানহীন খাবার নিয়ে সবার মাঝে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছেই। পণ্যের মান নিশ্চিত করতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জন্য বঙ্গবাজার মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক একটি খাদ্য পরীক্ষাগার বা ল্যাব। কোটিরও বেশি অধিবাসী অধ্যুষিত রাজধানীতে খাদ্যের মান পরীক্ষা করতে এ ল্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দম ফেলারও ফুরসত পাওয়ার কথা নয়। অথচ বাজারে ভেজাল তথা মানহীন খাবারের সয়লাব সত্ত্বেও এ ল্যাবে নেই কোনো কর্মব্যস্ততা। অলস সময় পার করতে দেখা যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন থেকে ভেজালবিরোধী অভিযানে যেসব খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করা হয়, তা পরীক্ষা করে মানসম্মত নাকি মানহীন, তা নির্ধারণ করা হয় এই পরীক্ষাগার থেকে। খাদ্য মানহীন হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী মামলা ও আর্থিক জরিমানা করে থাকে সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট ১৮ জন স্বাস্থ্য পরিদর্শক রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ১০, উত্তরে আটজন। এই পরীক্ষাগারে ৭০টি খাদ্য ও পানীয়ের নমুনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। এককথায় ঢাকাবাসীর নির্ভেজাল খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের; কিন্তু ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ ল্যাবের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, বছরের অর্ধেক সময় খাদ্য পরিদর্শকরা মশা মারার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। কারণ মে বা জুন মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। সিটি করপোরেশনের মশক কর্মী সংকট থাকায় এ খাদ্য পরিদর্শকদের কাজে লাগায় সংস্থা দুটি। আর বাকি অর্ধেক সময় নামমাত্র খাদ্য নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে এই ল্যাবে পরীক্ষা হয়েছে ২৯০টি, যা মাসে গড়ে ৩২টি অর্থাৎ প্রতিদিন একটি করে। একই সঙ্গে ৯ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে কোনো নমুনা সংগ্রহ করেননি খাদ্য পরিদর্শকরা। এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চ থেকে বাণিজ্যিকভাবেও পণ্য পরীক্ষা করার সুযোগ চালু হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বা কোম্পানিগুলো নিজ উদ্যোগে তাদের পণ্যের মান পরীক্ষা করতে পারবে। গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে মোট ৬২টি পরীক্ষা হয়েছে। আধুনিক এই পরীক্ষাগারটিতে ২০২০ সালে ৩৫৬টি খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ৫৩টি মানহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০২১ সালে ৫২৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ১০১টি এবং ২০২২ সালে ৪৪২টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৩টি মানহীন খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে ২৯০টি নমুনা পরীক্ষায় ২০টি মানহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬১১টি নমুনা পরীক্ষা করে ২১৭টি মানহীন খাদ্যপণ্য চিহ্নিত করে ল্যাবটি। এর আগে ২০২০ সালের ২ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আধুনিক এই পরীক্ষাগার উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ওই সময় ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, এ ল্যাব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সংগত কারণেই আমরা যে কোনো পণ্যের মান সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারব এবং ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব। ঢাকাবাসীর জনস্বাস্থ্য তথা স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে এই আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আধুনিক এই পরীক্ষাগারটিতে এক জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক, দুই রসায়নবিদ, দুই টেকনিশিয়ান, দুই পিয়ন ও একজন দারোয়ান রয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালক না থাকায় অনেকটাই স্থবির ছিল এর কার্যক্রম। ডিসেম্বরে পরিচালক যোগদানের পর আবার শুরু হয় পরীক্ষার কাজ; কিন্তু পরীক্ষার জন্য পণ্য না থাকায় অলস সময় পার করা ছাড়া কিছু করার নেই ল্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পরীক্ষা কম হওয়া প্রসঙ্গে ডিএসসিসির এক খাদ্য পরিদর্শক বলেন, নমুনা সংগ্রহ অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে কম করা হয়। কারণ নিরাপদ খাদ্য আইন জটিল। এই আইনের ২৩, ২৪,২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৭ ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলা জামিন হয় না। এ ছাড়া সর্বনিম্ন জরিমানা ৩ লাখ টাকা। আমরা যদি ছোটখাটো কোনো হোটেল পরিদর্শন করি, তাহলে ওই মালিকরা কি এত টাকা দিতে পারবেন! অনেকটা অসম্ভব। তাই আইনকে আরও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক (এনালিস্ট) মো. শামছুল হক বলেন, এখানে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে খাদ্যদ্রব্যের মান নির্ণয় করা হয়। আমরা বিএসটিআই মানদন্ড অনুযায়ী পরীক্ষা করে মানসম্মত ও মানহীন খাদ্যদ্রব্য চিহ্নিত করি। কম পরীক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খাদ্য পরিদর্শকরা নমুনা নিয়ে এলে পরীক্ষা করা হয়। তারা যে পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসেন তাই পরীক্ষা করা হয়। শুধু তাদের নমুনা সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, সরকারি ও বাণিজ্যিকভাবে আধুনিক ল্যাবে পরীক্ষা কার্যক্রম চলছে। চালু হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শকরা নিয়ে আসা পণ্যের মান পরীক্ষা করা হতো। চলতি বছরের মার্চ থেকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ যে কেউ চাইলে তাদের পণ্যের মান পরীক্ষা করতে পারবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত কয়েক মাস খাদ্য পরিদর্শকরা মশা মারার কাজে ছিলেন। এ জন্য নমুনা সংগ্রহ কম হয়েছে। এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমেছে, তাই এখন ফুলটাইম নমুনা সংগ্রহের কাজে থাকবেন তারা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button