Trending

ভেজাল খাদ্যে দীর্ঘমেয়াদি রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে দেশ

ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, লিভারে সমস্যা, হৃদরোগ, স্নায়ু অকার্যকর হওয়া ও উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিস্তার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এসব রোগে যেমন মৃত্যু বাড়ছে, তেমনি চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে বহু পরিবার।

ভেজাল খাদ্যে দীর্ঘমেয়াদি রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে দেশ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যে বিষাক্ত ভারী ধাতু যুক্ত হচ্ছে। তবে দেশে এখনো ভারী ধাতু পরিশোধনের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে।

বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারি তথ্য মতে, দেশের ৭০ শতাংশ মৃত্যু হয় দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে ক্যান্সারে প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে দেড় লাখ মানুষ, মারা যাচ্ছে এক লাখ আট হাজার।

পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতিবছর কিডনি বিকল হচ্ছে ৪০ হাজার মানুষের, তাদের ৭৫ শতাংশ মারা যায় ডায়ালিসিস বা কিডনি সংযোজন ছাড়াই। হৃদযন্ত্র ও রক্তনালির রোগে মৃত্যু হয় দুই লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের।

এমন পরিস্থিতিতে ‘স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সমৃদ্ধি চাই, নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি দিবসটি উপলক্ষে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, মানুষের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার পরের ধাপই হলো নিরাপদ খাদ্য। বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এখানে লোকজন অনেক বেশি।

বে-নজির আহমেদ বলেন, খাদ্যে ইনসুলিন তৈরি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, ভারী ধাতুর কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চাল সাদা করার জন্য ইউরিয়া দেয়। এই ইউরিয়া গ্যাস্ট্রিক-আলসারের জন্য দায়ী। আমাদের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে গ্যাস্ট্রিকের রোগী নেই। কলা বা ফল পাকাতে কেমিক্যাল ব্যবহার হচ্ছে এতে মানুষের লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে। টমেটো-আনারসে হরমোন ব্যবহার হয়, পোল্ট্রি ফিডে হাড়ের গুঁড়া দেয়, সেখানে যে ভারী ধাতু ব্যবহার করা হয় এগুলো আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। যে কারণে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা ব্যাটারিসহ এ ধরনের অন্যান্য ভারী ধাতুসম্পন্ন বর্জ্য যত্রযত্র ফেলা হয়ে থাকে। যা মাটি-পানি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তেমনি ফল-ফসল, গবাদি পশু ও মাছের শরীরেও সহজেই ঢুকে যায়। আর এসব মাছ-মাংস কিংবা শাক-সবজি, ফল মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে তা মানুষের দেহে ঢোকে।

বিভিন্ন গবেষণায় যা দেখা গেছে

সর্বশেষ খাদ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ফ্রন্টিয়াসে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুরগির মাংস ও মাছে মিলেছে সিসা, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ভারী ধাতু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বোতলজাত ৬৬.৭ শতাংশ ও খোলা ২৪.৫ শতাংশ সয়াবিন তেলে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটি এসিড (টিএফএ) রয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বলছে, এই মাত্রা ১ শতাংশের বেশি যেন না হয়।

সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৭ সালের নভেম্বরে পরিচালিত খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ক সমীক্ষার দেখা যায়, ঢাকার ৯০ শতাংশ স্ট্রিট ফুডই (রাস্তার খাবার) অনিরাপদ। এতে ই-কোলাই ও সালমোনেলার মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। ২০২১ সালে ঢাকার পানির মান নিয়ে একই প্রতিষ্ঠানের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের দোকানে ব্যবহার করা পানির ৯৪ শতাংশে মলের জীবাণু, ৪৪ শতাংশ পানিতে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও ২৯.৪ শতাংশ পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতু মিলেছে। এর আগে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় ৫৫ শতাংশ রাস্তার খাবারে ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল; আর ৮৮ শতাংশ বিক্রেতার হাতে অস্বাস্থ্যকর জীবাণু থাকে।

২০১৩ সালে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন পাস করে। এরপর ২০১৫ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সরকারের এই সংস্থাটি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পেরেছে ২০২০ সাল থেকে।

দেশে যেকোনো খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খাদ্য ও ভোক্তা অধিকার বিভাগের সদস্য আবু নূর মো. শাসুজ্জামান বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য রাতারাতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের দেশে একটা বিশাল অংশ এখনো বাইরের খাবার খায়। বিশেষ করে দুপুরের খাবার, সকালের নাশতা বেশির ভাগ মানুষ বাইরে খায়। রাস্তার খাবার যারা বিক্রি করে তাদের আমরা লাইসেন্সের আওতায় আনতে পারিনি। ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হয়নি।’

আবু নূর মো. শাসুজ্জামান বলেন, ‘যেকোনো প্রগ্রাম সফলতার মুখ দেখে সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিলে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সেটা সামনে রেখে কাজ করছি। এ জন্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং সারা বাংলাদেশে আয়োজন করেছি। স্কুলে প্রগ্রমিং করছি।’

বাংলাদেশ স্ট্যাডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) উপপরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, ‘এ পর্যন্ত ২৭৩টি পণ্য বিএসটিআই থেকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া বিক্রি করা নিষেধ। এর মধ্যে ১০২টি খাদ্যপণ্য। বিএসটিআই শুধু প্রসেস কোট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানসম্পন্ন মনে করলে লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। লাইসেন্স নেওয়ার পরে কোনো প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পণ্য বাজারজাত করছে কি না, তা অথবা লাইসেন্স ছাড়া বাজারজাত করছে কি না, তা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটর করে।

তিনি বলেন, ‘বাজার থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পণ্য আমরা নিজেরা কিনে বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষা করে থাকি। পরীক্ষায় যদি কোনো পণ্য নিম্নমানের পাই প্রথমে শোকজ করি এবং ব্যাখ্যা শুনি। পরে দ্বিতীয়বার যদি নিম্নমানের পাওয়া যায় তাহলে লাইসেন্স বাতিল করে পত্রিকায় দিয়ে মানুষকে সচেতন করি।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে খাবারে রাসায়নিক থেকে শুরু করে রং মেশানো হচ্ছিল। এর প্রেক্ষাপটে আমাদের সবার প্রত্যাশা এবং দাবি ছিল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য। সেটি হয়েছে, তার পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ৬৭ শতাংশ সয়াবিনে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটি এসিড পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে, অথচ বাংলাদেশে এ কারখানা রয়েছে। খাবারে কৃত্রিম রঙের ব্যবহার এখনো বন্ধ হয়নি। অতিরিক্ত কীটনাশক এবং সার ফসলে-শস্যে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা রোগমুক্ত সুস্থ জীবনের জন্য যে খাবার খাই, তা রোগ তৈরি করছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d