Bangladesh

ভেজাল চেতনানাশকে তিন শিশুর মৃত্যু 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভেজাল চেতনানাশকে তিন প্রতিবন্ধী শিশু মারা গেছে। ব্যবহৃত ওষুধের নমুনা পরীক্ষায় মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করেছে বিএসএমএমইউ। বিএসএমএমইউর সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকেরা এ তথ্য জানিয়েছেন। 

এই তিন শিশু ছাড়াও গত তিন-চার মাসে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে চেতনানাশক প্রয়োগের পর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এসব মৃত্যুর কারণও ভেজাল চেতনানাশক হতে পারে। বাজারে নকল বা ভেজাল চেতনানাশক ‘হ্যালোথেন’ রয়েছে। 

চার মাসের ব্যবধানে বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বয়স পাঁচ বছরের কম। তারা ছিল শ্রবণপ্রতিবন্ধী।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চেতনানাশক ‘হ্যালোথেন’ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। দেশে হ্যালোথেন তৈরি করত শুধু এসিআই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসিআইয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাপী হ্যালোথেনের ব্যবহার কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এসিআই গত বছরের জুন মাস থেকে হ্যালোথেনের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দেয়। 

হ্যালোথেন রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে নিশ্বাসের সঙ্গে রোগীর শরীরে দেওয়া হয় এটি। 

অবেদনবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএ-সিসিপিপি) ধারণা, বাজারে নকল হ্যালোথেন আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চেতনানাশক ব্যবহারের পর বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনার পেছনে এই নকল বা ভেজাল হ্যালোথেন থাকতে পারে। 

পরপর একাধিক ঘটনা (শিশুমৃত্যু) ঘটে যাওয়ার পর আমি বিভাগের চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলি। তাঁরা ব্যবহৃত ওষুধের নমুনা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) পাঠিয়েছিলেন। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওষুধে নানা ধরনের অবাঞ্ছিত রাসায়নিক ছিল।

অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, বিএসএমএমইউর সদ্য বিদায়ী উপাচার্য

তিন শিশুর মৃত্যু

চার মাসের ব্যবধানে বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বয়স পাঁচ বছরের কম। তারা ছিল শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তাদের মধ্যে দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে শিশু। 

বিএসএমএমইউ সূত্র জানিয়েছে, শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শ্রবণসহায়তায় কানে বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। এর নাম ‘কক্লিয়ার’। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক–কান–গলা বিভাগে ‘কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ নামের একটি কর্মসূচি আছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় এই কর্মসূচি থেকে দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুদের কক্লিয়ার দেওয়া হয়। বাজারে একেকটি কক্লিয়ারের দাম ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা। শিশুদের সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার পর কানে কক্লিয়ার বসানো বা স্থাপন করা হয়। এই তিন শিশুকেও কক্লিয়ার স্থাপনের আগে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে হ্যালোথেন দেওয়া হয়েছিল। তাদের একজন মারা গেছে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর, এরপর একজন ১০ জানুয়ারি এবং শেষ জন ৩০ জানুয়ারি। 

ঢাকার একাধিক হাসপাতালে খতনা করতে গিয়ে শিশুমৃত্যু, নারায়ণগঞ্জে টনসিল অস্ত্রোপচারের সময় একাধিক মৃত্যু ছাড়াও টাঙ্গাইলে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব মৃত্যুর পেছনে হ্যালোথেন থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

অধ্যাপক কাওছার সরদার, বিএসএ-সিসিপিপির সাধারণ সম্পাদক

বিএসএমএমইউর সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ গত সোমবার বলেন, ‘পরপর একাধিক ঘটনা (শিশুমৃত্যু) ঘটে যাওয়ার পর আমি বিভাগের চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলি। তাঁরা ব্যবহৃত ওষুধের নমুনা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) পাঠিয়েছিলেন। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওষুধে নানা ধরনের অবাঞ্ছিত রাসায়নিক ছিল।’

অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা শিশুদের শরীরে হ্যালোথেন দিয়েছিলেন। বিভাগের পক্ষ থেকে সেই হ্যালোথেনের নমুনা বিসিএসআইআরে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগে চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেবাশিস বনিক গত সোমবার বলেন, নমুনা পরীক্ষায় নানা ধরনের রাসায়নিক পাওয়া গেছে। 

ওই বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক দেবব্রত বনিকও হ্যালোথেন ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি দেশে অবেদনবিদদের সংগঠন বিএসএ-সিসিপিপিরও সভাপতি। তিনি গত সোমবার বলেন, ওই হ্যালোথেন অরিজিনাল ছিল না। তা ছিল ভেজাল মেশানো।

হ্যালোথেন রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবেদনবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএ-সিসিপিপি) ধারণা, বাজারে নকল হ্যালোথেন আছে।

গত ২৮ মার্চ বিএসএমএমইউতে অবেদনবিদদের সংগঠন বিএসএ-সিসিপিপির জাতীয় সম্মেলনেও হ্যালোথেনজনিত মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। সম্মেলনে বলা হয়, যেকোনো নামে হ্যালোথেন ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি ও রোগীর ওপর প্রয়োগ সরকারি আদেশের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প চেতনানাশক ব্যবহারে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়।

বিএসএ-সিসিপিপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কাওছার সরদার বলেন, ঢাকার একাধিক হাসপাতালে খতনা করতে গিয়ে শিশুমৃত্যু, নারায়ণগঞ্জে টনসিল অস্ত্রোপচারের সময় একাধিক মৃত্যু ছাড়াও টাঙ্গাইলে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব মৃত্যুর পেছনে হ্যালোথেন থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

আমরা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। বাজারে যেন হ্যালোথেন না থাকে, পাচার হয়ে যেন দেশে না ঢোকে, তার পদক্ষেপ নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। আমরা সব হাসপাতালে হ্যালোথেন ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছি।

অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক

হ্যালোথেন কেন ব্যবহার করা হলো

গত বছরের ১৫ জুন এসিআইয়ের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেশের চিকিৎসকদের কাছে এবং চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর কাছে দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী হ্যালোথেনের ব্যবহার কমে আসছে এবং ভবিষ্যতে হ্যালোথেনের বাণিজ্যিক ব্যবহার থাকবে না। তাই তারা হ্যালোথেন উৎপাদন ও সরবরাহের অবস্থায় আর নেই। এসিআইয়ের পক্ষ থেকে হ্যালোথেনের বিকল্প ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। 

এর চার দিন পর ১৯ জুন এসিআই কর্তৃপক্ষ সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরেকটি চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, হ্যালোথেন তৈরির কাঁচামালের সরবরাহ না থাকায় তাদের পক্ষে বাজারে হ্যালোথেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

ওই চিঠির পর আট মাস চলে গেছে। বিএসএমএমইউ বা অন্য হাসপাতালে এত দিন পরে কীভাবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউর দুটি বিভাগ একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। 

অধ্যাপক দেবাশিস বনিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্র ও হ্যালোথেন কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রকল্পের। আমরা শুধু জনবল দিয়েছি।’

অন্যদিকে নাক–কান–গলা বিভাগের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক এ এইচ এম জহিরুল হক বলেন, ‘আমরা হ্যালোথেন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা জানি না। আমাদের জানার কথাও না। এটা অবেদনবিদদের জানার কথা। তাঁরা কাজটি নিয়মিত করেন।’

স্বাস্থ্য বিভাগ কী করছে 

চিকিৎসকদের কাছে ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চিঠি দেওয়ার পর বাজারে হ্যালোথেনের কী পরিস্থিতি, কোথা থেকে সরবরাহ হচ্ছে তা কেউ খতিয়ে দেখেনি। এর মধ্যে বেশ কয়কটি মৃত্যুর পর অনেকে ধারণা করছেন, বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ, না হয় নকল বা ভেজাল হ্যালোথেন আছে। এরপরই ২৭ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক আদেশে বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি কোনো হাসপাতালে হ্যালোথেন ব্যবহার করা যাবে না। হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সব হাসপাতালে আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন ব্যবহারের উপযোগী নতুন যন্ত্র কেনা ও ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। বাজারে যেন হ্যালোথেন না থাকে, পাচার হয়ে যেন দেশে না ঢোকে, তার পদক্ষেপ নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। আমরা সব হাসপাতালে হ্যালোথেন ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছি। সব জেলার সিভিল সার্জনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালে নজরদারি বাড়াতে। হ্যালোথেনের বিকল্প চেতনানাশক ব্যবহারে কত যন্ত্র আছে, কত যন্ত্র প্রয়োজন সেই সংখ্যা নির্ণয়ের কাজও চলছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d