ভোক্তার আয়ের চেয়ে ব্যয় ২ শতাংশ বেশি
ভোক্তার খরচ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে আয় বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। ভোক্তার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। আয়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। দীর্ঘসময় আয় বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকায় ভোক্তার জীবনযাত্রাকে নেতিবাচক ধারায় প্রভাবিত করেছে।
রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির গতিশীলতা, এপ্রিল-জুন ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মূল্যস্ফীতির গতিপথ নিয়ে এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গবেষণাধর্মী ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন। এর দ্বিতীয় সংখ্যা এবার প্রকাশিত হলো। এর আগে মে মাসে জানুয়ারি-মার্চ ২০২৪ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুনে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমায় আয় ও ব্যয় বাড়ার ব্যবধান কিছুটা কমেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে আগামী দিনে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যবধান আরও কমে আসবে।
বৈশ্বিক মন্দা শুরুর পর থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। এর বিপরীতে আয় বাড়ার হার কমতে থাকে। ফলে আয় ও ব্যয় বাড়ার মধ্যকার ব্যবধানও বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে আয় বাড়ার চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়তে থাকে। এর আগে আয় বাড়ার চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার তুলনামূলকভাবে কম বেড়েছিল।
গত জুনে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এর বিপরীতে ভোক্তার আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আয়ের চেয়ে খরচ বেড়েছে ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়ও বাড়ছে। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল ৯.৮৯ শতাংশ এবং এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য বাড়লেও মে মাসের তুলনায় জুনে কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে আয় বৃদ্ধির হার তিন মাস ধরেই বাড়ছে। এপ্রিলে ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, মে মাসে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং জুনে তা আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। মে মাসের তুলনায় জুনে মূল্যস্ফীতির হার কমায় এবং আয় বৃদ্ধির হার বাড়ায় আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পচনশীল পণ্যগুলোয় (শাকসবজি ও তাজা ফলমূল) মূল্যস্ফীতির অবদানের ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। গত মার্চে মোট মূল্যস্ফীতির হারে পচনশীল পণ্যের অবদান ছিল ২৮ শতাংশ। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। আলোচ্য সময়ে এ খাতে ১০ শতাংশ কমেছে। এ কারণে জুনে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছিল।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সেবা খাতের ওপর পড়েছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় আমদানিকেন্দ্রিক পণ্যগুলোর দাম বাড়ায় এ খাতে মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে, যা সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
সেবা ও অপচনশীল পণ্যের দাম বাড়ায় সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হারে এ দুটি খাতের অবদানও বেড়েছে। গত মার্চে মোট মূল্যস্ফীতির ওপর সেবা খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। অপচনশীল পণ্যে অবদান মার্চে ছিল ৬১ শতাংশ। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে।
এদিকে ডলারের দাম এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি পণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। গত মার্চে মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে আমদানি পণ্যের মূল ভূমিকা ছিল ২৮ শতাংশ। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, কিছু নিত্যপণ্যের মুনাফার মার্জিন প্রান্তিক পর্যায় থেকে খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে। চাল, পেঁয়াজ, সোনালি মুরগি, সয়াবিন তেল, আলু, ফার্মের ডিমের ব্যবসার ক্ষেত্রে মুনাফার মার্জিন বেড়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের প্রান্তিক, পাইকারি ও খুচরা মূল্যের মধ্যকার মুনাফার মার্জিন বেড়েছে। মার্জিন বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বেড়েছে। এর বিপরীতে ভোক্তার খরচ বেড়েছে। মুনাফার মার্জিন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সয়াবিন তেল ও সোনালি মুরগির ক্ষেত্রে। এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমায় এর আমদানি খরচ কমেছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে এর দাম কমেনি। বরং আরও কিছুটা বেড়েছে। ফলে পাইকারি পর্যায় থেকে খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফার মার্জিন বেড়ে গেছে। তবে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মার্জিন আগের মতোই আছে। এর মানে হচ্ছে মিল মালিকরা বেশি মুনাফা করছেন। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও পাইকারি সরবরাহে দাম কমায়নি। ফলে খুচরা বাজারেও কমেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকেও আঘাতের প্রবণতা বাড়ছে। দীর্ঘ সময় এ হার চড়া থাকায় এর প্রভাব এখন দৃশ্যমান ও প্রকট হচ্ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করায় এ খাতে মানুষের খরচ বেড়েছে। মানুষ খাদ্যের পেছনে বেশি ব্যয় করে বলে খরচের মাত্রাও বেড়েছে।