Hot

ভোক্তার স্বস্তির বড় মূল্য দিতে হচ্ছে কৃষককে

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা এস এম শহীদুল কবির লিপু। ২৫ বিঘা জমিতে তাঁর সমন্বিত খামার। সেখানে নানা ধরনের সবজি ফলান তিনি। এবার ফলন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে জানালেও কণ্ঠে ছিল হতাশার সুর। 

হতাশার কারণও জানালেন লিপু। বললেন, ‘এবার রোজার সময় তোলা আমার একটা ফুলকপির উৎপাদন খরচ ছিল ১০ টাকা। ক্ষেতে বিক্রি করেছি দুই টাকা দরে। অথচ শহরে গিয়ে তা বিক্রি হয়েছে ২০ টাকায়। তাহলে আমি কী পেলাম? আমি কীভাবে টিকে থাকব?’ তিনি বলেন, রোজায় ভালো দাম পেতে সব কৃষক একসঙ্গে ক্ষেত থেকে সবজি তুলেছেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সবাইকে।

এবার শীতকালে এবং রমজানের সময়ে সবজি, বিশেষ করে টমেটো, ফুলকপি, বেগুন, লাউ ইত্যাদির দাম অন্য বছরের চেয়ে কম ছিল। এতে ভোক্তারা স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

সম্প্রতি সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। কৃষকরা বলছেন, তাতেও শীত ও রোজার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি কৃষককে উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করবে। তাই কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান এবং ভোক্তাও যাতে খুশি থাকেন, তার জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের সুপারিশ হচ্ছে পর্যাপ্ত হিমাগার তৈরি করা। কৃষকের ক্ষতির ঝুঁকি নিরসনে কৃষি বীমার ব্যবস্থা করা। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের জন্য মূল্য কমিশন গঠন করা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে সচল করা। 

নিয়মিত বিভিন্ন কৃষিপণ্যের যৌক্তিক পাইকারি মূল্য ও পাইকারি বাজারের প্রকৃত মূল্যের তথ্য সংগ্রহ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি টমেটোর যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ২৬ টাকা। কিন্তু রমজান মাসে খুচরা বাজারে টমেটো বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়। একইভাবে কাঁচামরিচের যৌক্তিক পাইকারি মূল্য হওয়া উচিত প্রতি কেজি ৪৫ টাকা। রমজানে খুচরায় তা বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা কেজি দরে। মিষ্টিকুমড়ার যৌক্তিক মূল্য ২৪ টাকার স্থলে বিক্রি হয়েছে ২০ টাকায়।

বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিপণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে অন্তত তিন দফা হাতবদল হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি লাভ করেন। কিন্তু সবচেয়ে কম পান কৃষক। অনেক ক্ষেত্রে তারা উৎপাদন মূল্য পান না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরও তা জানে। তাদের তথ্যই বলছে, কৃষক যে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৯ টাকারও কম পান, সেটি ভোক্তাকে কিনতে হয় ২২ টাকায়।

শীত মৌসুমে আগাম ও স্বাভাবিক সময় মিলিয়ে এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় সবজির ফলন ভালো হয়েছে। এ কারণে শীত মৌসুমের পুরোটা সময়ই বাড়তি সরবরাহ ছিল। ফলে দামের খুব একটা ওঠানামা করেনি। পুরোটা সময় দাম বেশ কম ছিল।

খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আমিনুল হক বলেন, ‘প্রতি কেজি টমেটো উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ১০ টাকা। পাইকাররা চার কেজির দাম দিতে চান ১০ টাকা। কিন্তু টমেটো বাজারে নিতে আমার খরচ আছে কেজিতে তিন টাকা। কীভাবে বিক্রি করব? এ কারণে গাছেই টমেটো পচে যাচ্ছে; বিক্রি করছি না।’

দুর্বল ব্যবস্থাপনা, বিধিমালা শুধু কেতাবে
২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন এবং এর আলোকে তিন বছর পর কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা করা হয়। এই বিধিমালায় চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার হার ঠিক করে দেওয়া আছে। উৎপাদন পর্যায়ে কৃষক ফসল ও পণ্যভেদে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ যৌক্তিক মুনাফা করতে পারবে বলে উল্লেখ আছে। 

এই বিধিমালা অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় যৌক্তিক মুনাফা কত হবে, তা ঠিক করে দেওয়ার কথা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের। তাদের অধীনে বাজারভিত্তিক আলাদা কমিটি থাকার কথা। সেই কমিটিও কাগজে-কলমে আছে। কিন্তু কৃষকের স্বার্থে তাদের কোনো পদক্ষেপের নজির পাওয়া যায়নি।

ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী– এই পাঁচ জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে জেলা-উপজেলা ও বাজারভিত্তিক কমিটি আছে। এসব কমিটির অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। ঝিনাইদহ সদরের বাজারভিত্তিক কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান বলেন, আট মাস আগে ইউএনও অফিস থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, তাঁকে বাজারভিত্তিক কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কিন্তু এরপর কমিটির কোনো বৈঠক বা কার্যক্রমের খবর তিনি পাননি। বাকি তিনজনও প্রায় একই রকম তথ্য দেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. তাজউদ্দিন বলেন, বিশ্বের কোথাও ভরা মৌসুমে সবজির দাম এতটা কমে না। কোন অঞ্চলের কৃষক কোন জাতের কী পরিমাণ ফসল উৎপাদন করবেন, সরকারের তরফ থেকে এর একটি নির্দেশনা থাকা দরকার। কৃষকের উৎপাদন খরচ, খুচরা ও পাইকারি দর মৌসুমের শুরুতেই প্রকাশ করলে কৃষক লোকসানে পড়বেন না।

বাজার পরিদর্শনেই সীমাবদ্ধ কমিশন
কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সরকারের অনেক সংস্থা আছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। এমনকি প্রতিযোগিতামূলক দরে পণ্য ও সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার দায়িত্বে রয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। তাদের কাজ বাজার পরিদর্শন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

২০১৮ সালের আইনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন এ সংস্থার অন্যতম প্রধান কাজ। কৃষিপণ্যের বাজার সংযোগ সৃষ্টি ও সুষ্ঠু সরবরাহে সহায়তা করাও তাদের কাজ। কিন্তু সংস্থাটি শুধু মাঝেমধ্যে দাম নির্ধারণ করে দেয়। নিয়মিত ঢাকা শহরের দৈনিক পণ্যমূল্যের তালিকা করে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে পাঠায়। যদিও এই কাজটিতে বড় গলদ রয়েছে। প্রতিদিন দামের যে তালিকা দেওয়া হয়, তার সঙ্গে বাজারের দাম মেলে না।

২০২১ সালে ছয় ও ২০২৪ সালে ৫০ পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তবে ওই সময় একটি পণ্যের দামও কার্যকর করতে পারেনি তারা।

কৃষকের বাজার চলে না
এর বাইরে ঢাকাসহ সারাদেশে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘কৃষকের বাজার’ চালু করা হয়। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে কৃষকের বাজার শুধু শুক্রবার খোলা থাকে। দেশের সব জেলায় কার্যালয় থাকলেও মাঠে এ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কমই দেখা মেলে। 

কৃষকের পণ্য অনলাইনে বিক্রি করতে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘সদাই’ ওয়েবসাইট এবং দুটি মোবাইল অ্যাপ বানায় অধিদপ্তর। ২০২১ সাল থেকে এগুলো পরীক্ষামূলকভাবেই চলছে। এ অবস্থায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করে একই ধরনের আরেকটি অ্যাপ তৈরি করা হয়। সেই অ্যাপও চালু হয়নি।

এ ছাড়া দেড় দশক আগে গ্রামীণ কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং সরাসরি পাইকারের সঙ্গে যুক্ত করতে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় চালু হয় গ্রোয়ার্স মার্কেট। উত্তর-পশ্চিম শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের (এনসিডিপি) আওতায় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে স্থাপিত হয় এই বাজার। কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে নির্মিত এ বাজারের অধিকাংশ এখন অকৃষিপণ্যের ‘মার্কেটে’ পরিণত হয়েছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪৪ শতাংশ শাকসবজি এবং ফলমূল নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

ভালো ফলন হওয়ার পরও সবজি সংরক্ষণ ও মূল্য নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে সবজির চাহিদা কতটুকু এবং তার বিপরীতে কী পরিমাণ চাষ হচ্ছে, সেই তথ্য সরকারের কাছে থাকতে হবে। এই তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই কৃষককে সংকটে পড়তে হবে না। সরকারি উদ্যোগেই ফসল ক্রয় ও সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor