ভোট–পরবর্তী সহিংসতা ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নিজেদের মধ্যে সংঘাত বন্ধে দলের নেতারা জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভোটের আগে দলটির মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকি, এমনকি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন অস্ত্র প্রদর্শন, কিছু কিছু সংঘাত হয়েছে। তবে ভোটের পর সংঘাত প্রাণহানিতে রূপ নিয়েছে, যা ভাবাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, নিজেদের মধ্যে সংঘাত বন্ধে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুসারে, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন থেকে এ পর্যন্ত সংঘাতে নোয়াখালী, মাদারীপুর, নেত্রকোনা ও ঝিনাইদহে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েক শ মানুষ। এসব ঘটনায় আক্রমণকারী, আক্রমণের শিকার এবং আহত-নিহতের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। তাঁরা নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে সংঘাতে জড়িয়েছেন।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে নোয়াখালীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক পোলিং এজেন্টকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে ঝিনাইদহে নৌকার প্রার্থীর একজন সমর্থক এবং নেত্রকোনা ও মাদারীপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর দুই সমর্থক নিহত হন। ভোটের পর ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর, বাড়িতে হামলা, লুটপাট এমনকি ফসলের ক্ষতি করার ঘটনাও রয়েছে। এ সময় শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, গবাদিপশুসহ আসবাব লুটপাট হয়েছে।
নোয়াখালীর ঘটনা নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে টুকটাক সংঘাত হয়। তবে হত্যাকাণ্ড দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনবে বলে তিনি মনে করেন। এখন নোয়াখালী শান্ত বলেও জানান তিনি।
এবার ভোটটা খুব সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটের পর যা হয়েছে, সেটা সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনার ফল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপকভাবে তৎপর আছে।
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ভোটের পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিতে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর মন্ত্রিসভার শপথ, বিজয় উদ্যাপন চলছে। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও ঢাকায় নানা আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত রয়েছেন। ফলে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে একধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়। এ সুযোগে ভোটের মাঠে একে অপরের প্রতি ক্ষোভ থেকে সংঘাতে জড়াচ্ছেন কর্মী-সমর্থকেরা।
ভোটের পরে সংঘাত বন্ধের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এবার ভোটটা খুব সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটের পর যা হয়েছে, সেটা সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনার ফল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে তৎপর আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ব্যবস্থা নিচ্ছেন। দ্রুত সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নির্বাচনোত্তর সহিংসতার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। সংস্থাটির হিসাব অনুসারে, নির্বাচনের পর গত সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ ও সংঘাতে অন্তত ৬ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪০০ জনের বেশি। ৬০ জনের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় ২০০টির বেশি ঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তাদের হিসাবে, অন্তত ১৮টি জেলায় সংঘাতের তথ্য পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবারের ভোট গ্রহণ পর্যন্ত যা পরিবেশ ছিল, তাতে সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ। কিন্তু ভোটের পরের সংঘাত বিব্রতকর। এটা চলতে থাকলে দলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে।
প্রথমে এতটা গুরুত্ব দেয়নি আ.লীগ
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ভোটের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে সতর্ক থাকতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ে বার্তা দেয়। কিন্তু ভোটের পর নিজেদের মধ্যে সংঘাত বন্ধে প্রথমে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকেরা নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় কথা বলেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন।
সর্বশেষ সোমবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথ সভায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচন শেষে নিজেদের মধ্যে দোষারোপ ও অপরাধ খোঁজা বন্ধ করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেন। তিনি এই বিষয়ে বলেন, ‘যারা নির্বাচন করেছে, কেউ জয়ী হয়েছে, কেউ পারে নাই। সে ক্ষেত্রে আমি সকলকে অনুরোধ করব, একজন আরেকজনকে দোষারোপ করা বা কার কী অপরাধ, সেগুলো খুঁজে বেড়ানো বন্ধ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও কারও কষ্ট আছে, কারও কারও আনন্দ আছে। কিন্তু ওই আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, কান্না—সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। সবাইকে আবার এক হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’
এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচন উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। ৭ জানুয়ারির ভোটে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনীত ২৬৫ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন। অন্যদিকে সারা দেশের বিভিন্ন আসনে ২৬৯ জন আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। ভোটে যেসব আসনে মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, এর প্রায় বেশির ভাগেরই জয়ী ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে সংঘাতও হয়েছে দলের এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের।
‘সংঘাত বন্ধে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ’
মাদারীপুর-৩ (কালকিনি, ডাসার ও সদরের একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। ভোটে তাহমিনা জয়ী হয়েছেন। এই আসনে ভোটের আগে একাধিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। একজন নিহত হন। ভোটের পরদিন জয়ী প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলা হলে ১০ জন আহত হন। এর মধ্যে আহত একজন গত বৃহস্পতিবার মারা গেছেন।
অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বিষয়ে মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা গতকাল মঙ্গলবার বলেন, এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে। আশা করা যায় আর সংঘাত হবে না।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতাকারীদের সরাসরি দল থেকে বহিষ্কারের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের কেন্দ্র থেকে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পক্ষে দলীয় সিদ্ধান্ত থাকায় এবার তৃণমূলের পদধারী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য, দলের সমর্থক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অনেকে প্রার্থী হন। ফলে দলের মনোনীত নৌকার প্রার্থী আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে শক্তির ফারাক খুব একটা ছিল না। ৫৮ জন দলীয় নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়া এর প্রমাণ। তাঁরা কেউ কাউকে ছাড়তে চাননি। এ জন্য প্রচারের সময়, ভোটের দিন এবং ভোটের পরও সংঘাত চলছে।
তবে পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর আর এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না বলে আশা করছেন তিনি। এর মধ্যে দলের নেতারাও নানাভাবে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে তিনি জানান।