Trending

ভ্যাট জালের বাইরে কে? ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে ভ্যাটের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আয়করের জাল বিস্তারে মনোযোগী হওয়া উচিত

রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা হাসেম মিয়া। কাজ করেন রাজমিস্ত্রির। গ্রামে থাকা মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। কথা শেষে মোবাইলে আসা এসএমএস দেখেন ব্যালেন্স শূন্য। তিনি বলেন, ১০০ টাকা ফ্লেক্সিলোড করেছিলাম। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম তাতেই টাকা শেষ। গ্রাহকদের এই টাকার একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে সরকারের কোষাগারে। দেশে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির বেশি। এ তালিকায় শীর্ষ ধনীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দরিদ্র মানুষ। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন।

বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো।

একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন ফিরোজুল ইসলাম। তিনি জানান, জরুরি কাজের জন্য গ্রামের বাড়িতে বড় ভাইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট কার্ড থেকে ৫ হাজার টাকা পাঠাই। পরে স্টেটমেন্টে দেখি কার্ডধারী ব্যাংক প্রসেসিং ফি ও ভ্যাট বাবদ ২৩০ টাকা কেটেছে। আরেকবার কার্ড থেকে ১০০০ টাকা বিকাশে সেন্ড মানি করেছি। তাতে ২৩ টাকা কেটে রেখেছে। এত বেশি টাকা কেটে রাখা কি মেনে নেয়া যায়? এ ছাড়া যার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা কেটে রাখা হয়। যা এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক নামে পরিচিত। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বছরে দুইবার- একবার জুনে এবং একবার ডিসেম্বরে টাকা কেটে রাখা হয়। পুরোটাই ব্যাংক সরকারের হয়ে কালেক্ট করে সরকারের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়।

শুধু হাশেম মিয়ার মোবাইলে টাকা কাটা আর ফিরোজুল ইসলামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা কাটা নয়, এই চিত্র দেশের সব মানুষের। এমনকি বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের বেলায়ও একইভাবে সরকার ভ্যাট নিচ্ছে। কিন্তু সেই মানের সেবা পাচ্ছেন না ভ্যাটদাতারা। গ্রাহকরা বলছেন, এভাবে ভ্যাট নেয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার একটা প্রক্রিয়া। সূত্র বলছে, সরকার অর্থসংকটে ভুগছে। তাই মরিয়া হয়ে টাকা তোলার সহজ পন্থাগুলো বেছে নিয়েছে এনবিআর। তবে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করলেও অনেকেই তা সরকারি কোষাগারে জমা করেন না। ফলে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে আসন্ন বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে। এর ফলে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাকে। তখন একজন গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৬৯.৩৫ টাকার কথা বলতে পারবেন।

ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপরে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলেও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে তা কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর ২ বছর পর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে আগের ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে এটি ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।
এমনিতেই দফায় দফায় তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে সাধারণ মানুষের। আয় না বাড়ায় নিত্যপণ্যের বাজারে হাঁসফাঁস অবস্থা। এর বিপরীতে বাড়েনি মানুষের আয়। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ছে সব ধরনের মানুষ। 

এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে ভ্যাট আরোপ করা আছে। ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলেন, আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার না করলে তেলের দাম কমবে না। গত রমজান মাসে সরকার পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আরোপ করা শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু শুল্ক কমানোর সুফল পায়নি ভোক্তারা। লাভবান হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে শুল্ক কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে।

এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ভ্যাট যোগ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ মানুষ দামের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে ঠিকই ভ্যাট পরিশোধ করে। বিক্রেতারা কড়ায় গণ্ডায় হিসাব কষে তা আদায়ও করে। ভ্যাট বাড়ানোর অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়। আদায়কৃত ভ্যাট বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সরকারের কোষাগারে জমা দেয় না, অনেক সময় কিছু জমা দেয়। এ ফাঁকি ধরতে এনবিআরকে সক্ষম হতে হবে। তাই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও আদায় তেমন বাড়ে না। সরকার লাভবান কম হয়। সাধারণ মানুষ কিন্তু ভ্যাট পরিশোধ থেকে রেহাই পায় না। শেষ পর্যন্ত অসাধু ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হয়।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কর অব্যাহতি অথবা হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কিছু ইলেকট্রনিকস পণ্য। আগামী বাজেটে এগুলোর ওপর ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআরের। এর মধ্যে রেফ্রিজারেটর, এসি, মোবাইল ফোন ও এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া চিনিযুক্ত কিছু জুসের ওপর ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। বর্তমানে রেফ্রিজারেটর উৎপাদক পর্যায়ে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ, মূল্য সংযোজনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে তা ২ থেকে ৭.৫ শতাংশ, এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ। রেফ্রিজারেটর ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে ২ শতাংশের বেশি ভ্যাট বাড়ানো হতে পারে। এলপিজি সিলিন্ডারেও ভ্যাট সামান্য বাড়ানো হতে পারে।

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে ভ্যাটের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আয়করের জাল বিস্তারে মনোযোগী হওয়া উচিত। এতে সাধারণ মানুষের ওপর রাজস্বের বোঝা কমবে, সম্পদশালীরা নজরদারিতে আসবে।

সূত্র মতে, ভ্যাট আদায় করা হয় মূলত পণ্য এবং সেবার ওপর। পণ্যের ওপর ভ্যাট আদায় করা হয় তিনটি পর্যায়ে, (১) আমদানি পর্যায়; (২) উৎপাদন পর্যায়; এবং (৩) ব্যবসায়ী পর্যায়। ব্যবসায়ী পর্যায়ের মধ্যে ভ্যাট আদায় হয় পাইকারি পর্যায় ও খুচরা পর্যায়। আমাদের দেশে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। 

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) বা মূসকের (মূল্য সংযোজন কর) পরিধি ব্যাপক হারে বিস্তৃত করার পাশাপাশি নিত্য ব্যবহার্য কিছু পণ্যের ভ্যাটহারও বাড়ানো হতে পারে। ভ্যাটবৃদ্ধির কারণে বাড়তি দামের চাপে ভুগতে হবে ভোক্তাদের। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবাভেদে ২, ৩, ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto