Hot

ভ্যানে লাশের স্তূপ, আগুন দিয়ে পালায় পুলিশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রাক্কালে নির্বিচার গুলি চালিয়ে আশুলিয়া থানার সামনে অন্তত ১২ জনকে হত্যা করে পুলিশ। প্রথমে লাশগুলো একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানে স্তূপ করা হয়। পরে মর্গে নিতে তোলা হয় পিকআপে। সরকার পতনের পর হাজারো মানুষ যখন বাইপাইল এলাকার থানার দিকে মিছিল করে আসতে থাকে, পুলিশ তখন লাশভর্তি পিকআপে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। 
গত ৫ আগস্ট দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। ভ্যানে বস্তার মতো করে লাশ তোলার একটি ভিডিও গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সমকালের কাছে আসে। গত শুক্রবার তা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ ভিডিওর সূত্র ধরে সামাজিক মাধ্যমেই জানা যায় ভিডিওটি আশুলিয়া থানার গেটের সামনের সড়কের।

গতকাল শনিবার সেখানে গিয়ে ভিডিওর সত্যতা পাওয়া যায়। সমকাল সেদিনের আরও ১৮টি ভিডিও পেয়েছে স্থানীয় সূত্র থেকে। এতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হলুদ জার্সি পরা এক তরুণের মরদেহ ভ্যানে তুলেছে পুলিশ। আরেকটি ভিডিও থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, পিকআপে পোড়া দেহগুলোর একজনের গায়ে সেই হলুদ জার্সি। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, পুলিশই আগুন দেয় লাশগুলোতে।

আরেকটি সূত্র দাবি করেছে, সেই পিকআপে আহত কয়েকজন ছিল। তাদের পুলিশ ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়ক থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তুলে এনেছিল। তাদেরও পুড়িয়েছে পুলিশ। তবে এই দাবি অন্য কোনো মাধ্যম বা সূত্রে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে থানার ঠিক বিপরীতে রাশেদা সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার কক্ষ থেকে। এসব কক্ষে গিয়ে গতকাল কাউকে পাওয়া যায়নি। ভীতসন্ত্রস্ত ভবন মালিকের স্ত্রী ও ছেলে বলেন, ৫ আগস্ট তারা বাসায় ছিলেন না। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় মেস করে থাকেন স্থানীয় বিভিন্ন কারখানার কর্মচারীরা। যিনি ভিডিও করেছিলেন তিনি বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। 

গতকাল থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমানকে থানার বাইরে পাওয়া যায়। তিনি পেঁপে কিনে ফিরছিলেন। ৫ আগস্ট কী ঘটেছিল জানতে চাইলে, মন্তব্য করতে বিনয়ের সঙ্গে অস্বীকৃতি জানান। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে এই প্রতিবেদকের মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুত চলে যান। হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা তাও জানায়নি পুলিশ।  

তবে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ভবনটিতে আশ্রয় নেওয়া আন্দোলনকারীদের কয়েকজন সেই দিনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ভিডিও করেছিলেন। নিরাপত্তা শঙ্কা থাকায় সমকাল তাদের পরিচয় প্রকাশ করছে না। ভিডিওতে ভ্যানে লাশ ছুড়ে স্তূপ করতে যে দুই পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে, তাদের একজনের পরিচয় জানা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, তিনি ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ।

ভিডিওতে এই কর্মকর্তাকে সাদা গেঞ্জির ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর পাশে থাকা সাদা পোশাকের আরেক পুলিশ সদস্য ঢাকা জেলা উত্তর ডিবির বলে জানা গেছে।
দুটি ভিডিওতে লাল গেঞ্জির ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা অস্ত্রধারী এক ব্যক্তিকে দেখা গেছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সেই ব্যক্তি থানা থেকে মহাসড়ক অভিমুখী গলিতে গুলি করছেন। এতে একজন লুটিয়ে পড়েন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা যখন পিছু হটছিল, তখন নিরস্ত্র অবস্থায় উল্লাস করতে আসছিলেন কয়েকজন যুবক। তারা গলির ভেতরের মোড়ে আসতেই থানার পূর্বপাশের আরেকটি রাস্তার ভেতর থেকে গুলি করেন সেই লাল গেঞ্জি পরিহিত ব্যক্তি।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এই অস্ত্রধারী অন্য পুলিশের দিকে কিছু একটা ছুড়ে মারা যুবককে পাঁচ থেকে সাত ফুট দূরত্ব থেকে রাইফেল দিয়ে পর পর কয়েকটি গুলি করেন। সেই গুলিতে যুবকটি থানার বিপরীতে রাশেদা মার্কেটের দিকে উড়ে যায়।

ঢাকা থেকে গাজীপুরের চন্দ্রামুখী মহাসড়কের বাঁ পাশে বাইপাল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। পাশের গলি দিয়ে দেড় থেকে দুইশ গজ গেলেই থানা। এলাকাটি আশুলিয়া ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হতে আগ্রহী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন ভূঁইয়ার থানার পাশের ভবনের দেয়ালে লাগানো পোস্টারের ভাইরাল ভিডিওটির স্থান খুঁজে পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা ৫ আগস্ট বিকেলে থানা ভবন পুড়িয়ে দেয়। সে সময় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন।

সেদিন যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজনের নাম আবদুল মান্নান। আন্দোলনকারীরা তাঁর লাশ হাসপাতালে নিতে রাশেদা মার্কেটের পূর্ব দিকের গলি দিয়ে নিয়ে একটি দোকানের সামনে রাখেন। সেখানে একজন মেঝেতে রক্ত দিয়ে লিখে রাখেন, ‘আবদুল মান্নান, শহীদ। ০৫-০৮-২০২৪’।

আরেকজনের নাম মিজানুর রহমান (৩৭)। তাঁর বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জের ভেলামারি গ্রামে। তাঁর স্ত্রীর নাম শেফালি আক্তার। তারা দু’জনই স্থানীয় গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। শেফালি আক্তার জানান, তাঁর স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে। অন্য আন্দোলনকারী মিজানুরের লাশ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, থানা থেকে দক্ষিণ-পূর্বমুখী গলি দিয়ে গুলিবিদ্ধ অন্তত চারজনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে এক কিশোরের পরিচয় পাওয়া গেছে। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বীরঘর গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে তানজিল মাহমুদ সুজয় (১৭)।

আন্দোলনে সক্রিয় ছিল সুজন। মৃত্যুর আগের দিনও ফেসবুকে লিখেছিল, ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে বীর’। তার আত্মীয় আল আমীন বলেন, পিকআপে ১১ জন ছিল। তাদের সবাইকে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। সেখান থেকে সুজনের লাশ শনাক্ত করা হয় পকেটে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখে। 

স্কুল ছাত্র আস-সাবুরের (১৬) মরদেহ ছিল পুড়িয়ে দেওয়া পিকআপে। সে আশুলিয়ার জামগড়া শিমুলতলা এলাকার বাসিন্দা এনাফ নায়েদের ছেলে। আস-সাবুর শাহীন স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত। 
থানার বিপরীতের ইভা হোমিও হল এবং আবদুল্লাহ টেলিকম অ্যান্ড স্টেশনারি দোকানের কর্মচারী ও মালিকরা দাবি করেন, সেদিন দোকান বন্ধ থাকায় তারা কিছু দেখেননি। 
তবে সংলগ্ন এলাকার এক ব্যক্তি সমকালকে বলেন, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ মুখ বন্ধ রাখতে বলেছে। শাসানো হয়েছে, এই পরিস্থিতি বেশিদিন থাকবে না। আবার পুলিশের ক্ষমতা ফিরবে। এখন বিপদে ফেললে, ভবিষ্যতে দেখা নেওয়া হবে।

৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে খবর পাওয়া যায় সেনাপ্রধান ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। একে হাসিনার পতনের লক্ষণ ধরে দুপুর ২টার আগেই সারাদেশে কোটি মানুষ সড়কে নামেন। অন্যান্য এলাকা থেকে পুলিশ সরে গেলেও বাইপাইলের মূল সড়কে পুলিশ তখনও গুলি চালাচ্ছিল বলে সমকালকে জানান ফায়ার সার্ভিসে কাজ করা এক তরুণ। 

স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় জমায়েত হয় ছাত্র-জনতা। আবুল হোসেন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করতে করতে পিছিয়ে থানার দিকে যেতে থাকে। আন্দোলনকারীরাও থানার দিকে এগোতে থাকে। তারা গলিতে ঢুকে পড়লে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা যায়। তখন পুলিশ হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। 
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সে সময় কয়েকজন পুলিশ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথার ওপর হাত তোলে। কেউ কেউ অস্ত্র তোলে। ঠিক এ সময়েও উল্লাস করে আসতে থাকা তরুণদের দিকে গুলি চালায় কয়েকজন পুলিশ। গুলি করতে করতে তারা পশ্চিমের সড়ক ধরে চলে যেতে থাকে। এটি বিকেল ৪টার দিকের ঘটনা বলে জানা গেছে। 
ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট আব্দুল্লাহিল কাফীর নির্দেশে আশুলিয়ায় ছিলেন। ৫ আগস্ট কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। 

৫ আগস্ট আশুলিয়ায় পিকআপ ভ্যানে পোড়া ১১ জন ছাড়াও অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। ১৮ জুলাই থেকে নিহত হন অন্তত ৭৫ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে চার শতাধিক মানুষ। অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button