International

মণিপুরে নারী নিগ্রহ: ভিডিও প্রকাশের ৬২ দিন আগে থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ কিছু করেনি

ভারতের মণিপুর রাজ্যে সংগঠিত যৌন সহিংসতার ঘটনায় প্রতিবাদ

ভারতের মণিপুর রাজ্যে দুই নারীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় থানায় অভিযোগ করার ৬২ দিন পর্যন্ত এটিতে শুধু ধুলাই জমেছে। এর মধ্যে অভিযোগটি শুধু এক থেকে অন্য থানায় গেছে। নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, ভুক্তভোগীরা ঘটনার পর তাঁদের বাড়ি ছেড়ে অন্য জেলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানকার থানায় গিয়ে নির্যাতনের শিকার এক নারীর স্বামী লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু সেই অভিযোগটি সংশ্লিষ্ট থানায় আসতে সময় নেয় এক মাসের বেশি।

এই যৌন নির্যাতনের ভিডিও বুধবার রাতে প্রকাশ হওয়ার পর ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। এ ঘটনায় মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। তিনি বৃহস্পতিবার পুলিশের এই বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সহিংসতার ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি এফআইআর হয়েছে। ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর পুলিশ ঘটনাটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ভিডিওটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অপরাধীদের শনাক্ত কর অবিলম্বে ব্যবস্থা নিই। আমরা মূল অপরাধীসহ তাৎক্ষণিক দুজনকে গ্রেপ্তার করেছি।’

গত ৩ মে মণিপুরে মাইতি ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পরদিন ৪ মের ওই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের একটি দল গ্রামের রাস্তা দিয়ে দুই নারীকে হাঁটিয়ে ধানখেতে নিয়ে যাচ্ছে। দুই নারী সম্পূর্ণ নগ্ন এবং হাঁটতে হাঁটতেই তরুণদের কয়েকজন দুই নারীকে যৌন নিগ্রহ করছেন। দুই নারী কাঁদছেন এবং তাঁদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করছেন।

সংক্ষিপ্ত ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, নারীদের ধানখেতের ভেতর দিয়ে অজ্ঞাত কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই দুই নারীর একজন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল ১৮ মে। কিন্তু গত বুধবার ভিডিওটি প্রকাশের পরই পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

এর মধ্যে গত ২৭ মে থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে অন্তত ছয়টি বৈঠক হয়েছে। রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে ২৭ মে মণিপুর সফর করেন ভারতের সেনাপ্রধান মনোজ পান্ডে। ২৯ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ চার দিনের সফরে মণিপুর যান। সফরে রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন তিনি।

এরপর ৪ জুন গুয়াহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অজয় লাম্বাকে প্রধান করে মণিপুরের ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ১০ জুন নর্থ ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের প্রধান ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা মণিপুরের ইম্ফল সফর করেন। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। এরপর ২৪ জুন অমিত শাহর আহ্বানে নয়াদিল্লিতে বিষয়টি নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক হয়।

২৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে মণিপুরের ঘটনা নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছাড়াও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, জ্বালানিমন্ত্রী হরদ্বীপ সিং পুরিসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকগুলোতে নারীদের নিগ্রহের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংসহ সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

মণিপুরে নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ। নয়াদিল্লি, ভারত ২০ জুলাই

মণিপুরে নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ। নয়াদিল্লি, ভারত ২০ জুলাইছবি: এএফপি

পুলিশের এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে কেন দুই মাসের বেশি সময় লাগল, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল ঘটনাস্থল মণিপুরের থাউবাল জেলার পুলিশ সুপার সচিদানন্দকে। জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রমাণের অভাবে’ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘আমরা গতকালই ভিডিওর বিষয়ে জানতে পেরেছি। এখন আমাদের হাতে ভিডিটি প্রমাণ হিসেবে আছে। আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি এবং গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছি।’ তা ছাড়া ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা থাউবাল ছেড়ে যাওয়াকেও তিনি অজুহাত দেখিয়েছেন।

পুলিশের কাছে করা অভিযোগে দেখা যায়, উচ্ছৃঙ্খল জনতা যখন ওই নারীদের ছিনিয়ে নেয়, তখন তারা থাউবালের নংপোক সেকমাই থানার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন।

তাহলে পুলিশ সদস্যরা তখন কেন অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারেনি—এমন প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, এফআইআরে করা অভিযোগ অসত্য এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল না। তিনি বলেন, সেদিনই নংপোক সেকমাই থানার অস্ত্র লুট করতে চেষ্টা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। পুলিশ তখন থানা পাহারা দিতে ব্যস্ত ছিল।

অথচ ভুক্তভোগী এক নারী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে যা বলেছেন, তা পুলিশের বক্তব্যের বিপরীত। ওই নারী যিনি দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ, তিনি বলেছেন, উচ্ছৃঙ্খল জনতা ওই দুই নারীর গ্রামে যখন হামলা করে, তখন পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গেই ছিল। পুলিশ তাদের বাড়ির কাছ থেকে তুলে গ্রাম থেকে একটু দূরে রাস্তায় উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাছে ফেলে যায়। ‘পুলিশই আমাদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে,’ বলেন তিনি।

বিলম্বের আরেকটি কারণ হলো এক থানা থেকে আরেক থানায় অভিযোগটি পাঠাতে সময় লাগা। অভিযোগটি করা হয় কাংপোকপি জেলার সাইকুল থানায়। এরপর সেটি সংশ্লিষ্ট নংপোক সেকমাই থানায় পৌঁছায় ২১ জুন। এফআইআরে ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যাসহ নানা অভিযোগে ‘অজ্ঞাত ৯০০ থেকে ১ হাজার ব্যক্তিকে’ আসামি করা হয়।

‘আমাদের মায়েরা জ্বলছে, দেশ জ্বলছে’

শুক্রবার কলকাতার ধর্মতলায় বার্ষিক শহীদ সমাবেশে মণিপুরের ঘটনা নিয়েই ভাষণ শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘মণিপুরের মানুষকে আমরা জানাতে চাই, পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের মানুষ আপনাদের পাশে আছে। সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলতে চাই, বিজেপির প্রধান স্লোগান ছিল “বেটি বাঁচাও” অর্থাৎ মেয়েদের বাঁচাও। আজ তো দেশের মেয়েরা জ্বলছে। গুজরাটে বিলকিস বানুকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তারা জামিন পেয়ে গেছে। মণিপুরে অত্যাচারীদের দুই মাস পরও সাজা হয়নি। আমাদের মায়েরা জ্বলছে, দেশ জ্বলছে।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিবিরোধী সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি দল গঠন করে মণিপুরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

যা বললেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী

মণিপুরে দুই নারীর যৌন নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এমনকি এ নিয়ে ভারতের সংসদেও হট্টগোল হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এএনআইকে বলেন, তাঁর কাজ রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা। এরই মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য উল্লেখ করে বীরেন সিং বলেন, তাঁর সরকার অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে।

প্রধান অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন দিলেন নারীরা

শুক্রবার প্রকাশিত আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষুব্ধ নারীরা প্রধান অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন। বার্তা সংস্থা এএনআই বলছে, ভিডিওটি বৃহস্পতিবারের। আর আল-জাজিরার খবরে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা হেমন্ত পান্ডের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, স্থানীয় নারীরা প্রধান অভিযুক্তের বাড়িতে পাথর ছুড়েছেন এবং বাড়ির কয়েক জায়গায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, নারীদের নিগ্রহের ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনকে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।

Show More

3 Comments

  1. Hi there, all the time i used to check blog posts here in the early hours in the break of day, for the reason that i enjoy to gain knowledge
    of more and more.

  2. Great work! This is the kind of information that
    are meant to be shared around the internet. Shame on Google for not positioning this put up higher!
    Come on over and visit my website . Thank you =)

    My page :: Eternal life

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button