Bangladesh

মতিউরের স্ত্রীরও অঢেল সম্পদ, রাজাকারের নাতনি হয়েও উপজেলা চেয়ারম্যান!

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লাকী বর্তমানে রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। 

স্থানীয়রা জানান, চিহ্নিত রাজাকার আব্দুল কাদিরের নাতনি এই লাকী। তিনি এখন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। রাজাকার ও বিএনপি পরিবারের সন্তান হয়ে কিভাবে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হলেন তা নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে আলোচনা রয়েছে। 

মতিউরের প্রথম স্ত্রী লাকীর সংসারে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা নামে দুই সন্তান রয়েছে। অন্যদিকে ছাগলকাণ্ডে ভাইরাল তরুণ মুশফিকুর রহমান (ইফাত) তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফেনীর সোনাগাজীর শাম্মী আখতারের গর্ভের সন্তান।   

লাকী ছিলেন রাজধানীর তীতুমির সরকারী কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। 

শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লাকীর নামে বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। তার নির্বাচনী হলফনামা  থেকে জানা গেছে, বাৎসরিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা, কৃষিখাত থেকে ১৮ লাখ টাকা, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা, ব্যাংক সুদ  থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। 

বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমান ১৫৪ শতাংশ, অকৃষি জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।  

জানা গেছে, মতিউরের বাড়ি বরিশালের মূলাদীতে ১৫ শত বিঘা জমি রয়েছে। গাজীপুরে ১শ বিঘা জমির ওপর আপন ভ‚বন নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। নরসিংদীর মরজালে লাকীর নামে ৪০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে ওয়ান্ডার পার্ক। একই এলাকায় ৪ কানি জমির ওপর আলিশান বাড়ি রয়েছে। তার মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার নামে মরজাল বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশে রয়েছে ১০ বিঘা জমি। ময়মংসিংহের ভালুকায় রয়েছে জুতার কারখানা। নাটোরের সিংড়ায় ২০ বিঘা জমি এবং গাড়ীপুরের পুবাইলে একাধিক রিসোর্ট ও জমি রয়েছে।  

স্থানীয়রা জানান, লাকীর বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লাকী সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও মতিউরের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। লাকীর নানা আব্দুল কাদির চেয়ারম্যান ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। আব্দুল কাদির ছিলেন চিহ্নত রাজাকার ময়দর আলী দারোগার মেয়ের জামাতা। 

লাকীর বিরুদ্ধে জমি দলখের অভিযোগ রয়েছে। বিমান বাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি (লাকী) আমার জমিসহ অনেকের জমি দখল করেছেন। জমি ক্রয় করার কথা বলে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বাকি টাকা দেওয়ার পর রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে বলে কথা থাকলেও তিনি আর কোনো টাকা দেননি। এখন পার্কের জন্য ব্যবহার করছেন। আমি জমির দলিল করে দেইনি, জোর করে আমার জমি দখলে রেখেছেন। এছাড়া তিনি প্রশাসনিকভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। 

এ ব্যাপারে মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিন্দা সুলতানা নাসিমা বলেন, একজন শিক্ষক কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ওনি আওয়ামী লীগের পরিবারের সদস্য নন। ওনি রাজাকারের নাতিœ। ওনার বাবার বাড়ি, নানার বাড়ি সবাই বিএনপি। বিএনপি থেকে এসে উনি আওয়ামী লীগ সেজেছেন। 

রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসাইন বলেন, লায়লা কানিজ লাকী টাকার পাহাড় গড়েছেন। স্থানীয় এমপির উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। তার প্রভাব খাটিয়েই বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন। লাকীকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব ক্ষতি করে ফেলেছেন ওই এমপি। 

মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে মতিউর ও লাকী দম্পতির আধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি। এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে শুক্রবার দুপুরে ওই বাড়িতে গেলে ভেতরে ঢুকতে দেননি বাড়ির কেয়ারটেকার। তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান (লাকী) এখন বাড়িতে নেই। কোনো দরকার থাকলে রায়পুরা অফিসে যোগাযোগ করুন। কিন্তু অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button