International

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত আসলে কোনদিকে যাচ্ছে?

ইসরায়েল তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক হামলার শিকার হয়েছিলো এক বছর আগে সাতই অক্টোবর। তখন তারা সেই হামলার ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো ঠিক-ই, কিন্তু সেইসাথে ফিলিস্তিনের গাজায়ও বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।

তখনকার পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিলো, এবার সবকিছুর মোড় ঘুরে যাবে। বিশ্ব দরবারে টানা অনেক বছর ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত কিছু আড়ালে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্রে করে আচমকা তা ফের আমাদের চোখের সামনে ফিরে এলো।

এই গোটা বিষয়টি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলো তখন। ২০২৩ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত সেই হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, “গত দুই দশকের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য আজ অনেকটাই শান্ত।”

কিন্তু জ্যাক সুলিভানের ওই বক্তব্যের পর আজ এক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে। এই সময়ে ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। গাজার দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন আরও ৬০০ জন।

এই ধ্বংসযজ্ঞের রেষ ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। সেখানে ইসরায়েলি হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও অন্তত ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিলো ইসরায়েচলে। সেই হামলার প্রথম দিনেই এক হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হন। এরপর গাজায় ৩৫০ জনের বেশি ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন।

গাজার কাছাকাছি ও লেবাননের উত্তর সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত প্রায় দুই লাখ ইসরায়েলি নাগরিক তাদের বাড়িঘড় ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওইসময় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছিলো, তাতেও প্রায় ৫০ জন সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীও এই সংঘাতে যোগ দিয়েছে। তা থামাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের চেষ্টা করেছে। যেমন– দেশটির প্রেসিডেন্টের সফর, অসংখ্য কূটনৈতিক মিশন, বিপুল সেনা-সরঞ্জাম মোতায়েন। কিন্তু সেসবের কোনও চেষ্টাই আসলে কাজে দেয়নি।

চিরশত্রু ইসরায়েল ও ইরানের মাঝে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এটি সহসা থামবে বলে মনে হচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতে যে আরও ঘটবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের প্রভাব আগের চেয়ে তুলনামূলক কম বলে মনে হচ্ছে।

গত বছরের সাতই অক্টোবরের আগে গাজার বাসিন্দাদের জীবন কেমন ছিল, তা মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। কারণ গণমাধ্যম ক্রমাগত মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ আশঙ্কার কথা বলছে।

ওইদিনের সেই ভয়ানক ঘটনায় কিছু ইসরায়েলির জীবনও ওলট-পালট হয়ে গেছে। তারা অনেকে এখন অবহেলিত বোধ করছেন।

হামাস যাদেরকে জিম্মি করে নিয়ে গিয়েছিলো, তাদের একজন হলে নিমরোদ কোহেন। তার বাবা ইয়েহুদা কোহেন গত সপ্তাহে ইসরায়েলি কান নিউজকে বলেন, “আমাদেরকে একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

কোহেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করে বলেন যে দেশকে একটি “অর্থহীন যুদ্ধের দিকে” ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি নাগরিকদেরকে সম্ভাব্য শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মি. নেতানিয়াহুকে দায় দিয়েছেন।

অবশ্য সব ইসরায়েলি-ই যে ইয়েহুদা কোহেনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত, বিষয়টা তেমন নয়। অনেকে হামাসের ওই আক্রমণকে অন্যভাবে দেখেন। তারা মনে করেন, ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েলের শত্রুদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল সাতই অক্টোবরের ওই হামলা।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে এখন এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারে না।”

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি আসলে কোনদিকে যাচ্ছে?

“আমরা কেউ-ই জানি না এই সংঘাত কখন থামবে এবং সেসময় আমরা সবাই কোথায় থাকবো,” সম্প্রতি বিবিসি’র টুডে পডকাস্টে এসে এ কথা বলেছিলেন ইরানে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিমন গাস।

এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা’র সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল সফর দেখে মনে হয়, কূটনৈতিক উপায় খোঁজার চেয়ে ব্যবস্থাপনার দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি মনোযোগী।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর চার সপ্তাহ বাকি এবং এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বিষাক্ত অবস্থায় আছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কোনও সাহসী ও নতুন উদ্যোগ নিবে বলে মনে হয় না।

আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হল, বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ধারণা, গত সপ্তাহে ইরান ইসরায়েলের ওপর যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, সেটির জবাব দেওয়ার অধিকার আছে ইসরায়েলের, এটি ইসরায়েলের কর্তব্যও।

ওই হামলায় কোনও ইসরায়েলি নিহত হয়নি। হামলার ধরন দেখে মনে হয়, সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তু নিশানা করেছিলো ইরান। কিন্তু মি. নেতানিয়াহু ওই হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

কয়েক সপ্তাহের অভাবনীয় কৌশলগত সাফল্যের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এখন অনেক বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন বলে মনে হচ্ছে।

সরাসরি ইরানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া ভাষণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেছেন যে তেহরানের সরকারে পরিবর্তন আসছে। “শেষ পর্যন্ত ইরান যখন মুক্ত হবে, তখন সবকিছু পাল্টে যাবে। সেই সময়টি এত তাড়াতাড়ি আসবে যে তা মানুষের ধারনারও বাইরে।”

২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের আগে মার্কিন নব্যরক্ষণশীলরা এমনভাবেই কথা বলতো। নেতানিয়াহু’র বক্তব্য যেন তাদের কথারই প্রতিধ্বনি বলে মনে

কিন্তু এই মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনার জন্য দুর্বল হলেও কিছু বাধা এখনো রয়ে গেছে। ইরানের শাসকরা ইসরায়েলবিহীন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতেই পারে, কিন্তু তারাও জানে যে এই অঞ্চলের একমাত্র পরাশক্তিকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ইরান খুবই দুর্বল।

বিশেষ করে, এমন এক সময়ে যখন ইরান সমর্থিত হামাস ও হেজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসরায়েল। একইভাবে, ইরানের দেওয়া হুমকি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেতে চায় ইসরায়েল। কিন্তু ইসরায়েল জানে যে সাম্প্রতিক সময়ে তারা বিভিন্ন অভিযানে সফল হলেও তারা একা এই কাজ করতে পারবে না।

ইরানে সরকার পরিবর্তনের যে আশঙ্কা, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এজেন্ডা বা লক্ষ্যের মাঝে নেই। এমনকি, ভাইস প্রেসিডেন্টের এজেন্ডাতেও তা নেই।

২০১৯ সালের জুনে ইরান একটি মার্কিন সার্ভেইল্যান্স ভূপাতিত করার পর এক পর্যায়ে মনে হয়েছিলো যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানে হামলা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেন। যদিও এর সাত মাস পর তিনি ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আজ থেকে এক বছর আগে খুব কম মানুষই কল্পনা করেছিলো যে, মধ্যপ্রাচ্য এতটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকের মাঝে এমনটা আসেনি।

মধ্যপ্রাচ্যের পথে পথে এখন অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এখনও উদ্বেগজনক গতিতে নানান ধরনের ঘটনা ঘটছে সেখানে। নীতিনির্ধারকসহ সবাই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

গাজা যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। এই যুদ্ধ যখন শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হবে, তখন গাজাকে কিভাবে পুনর্গঠন ও পরিচালনা করা হবে, তা নিয়েও এখন কোনও কথাবার্তা হচ্ছে না।

ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের চলমান বিরোধ সমাধান নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও একদিন যদি ইসরায়েলের মনে হয় যে তারা হামাস ও হেজবুল্লাহ’র যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে বা যখন মার্কিন নির্বাচন শেষ হবে, তখন হয়তো সংকট সমাধানের সুযোগ আসবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d