Trending

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে জ্বালানি তেলের দাম কি প্রতি ব্যারেলে ১০০ ডলার ছাড়াবে?

তেল আবিব এই পথে হাঁটলে তার রাজনৈতিক মূল্যও দিতে হবে। জ্বালানি তেলের দর বাড়লে নাখোশ হন আমেরিকান ভোটাররা। সামনে নভেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার মাত্র এক মাস আগে এই ধরনের হামলায় বেজার হবে বাইডেন প্রশাসন। আবার ইরানের অধিকাংশ জ্বালানি তেলের ক্রেতা চীনকেও ক্ষুদ্ধ করবে এই পদক্ষেপ। ইসরায়েলের জন্য সেটাও চিন্তার কারণ, কারণ তাদের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হাইফা পোর্ট– পরিচালনার পাশাপাশি দেশটির প্রযুক্তি খাতের বড় বিনিয়োগকারীও চীন। 

এক বছর আগে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজার ছিল আশঙ্কার দোলাচালে। ভয় ছিল এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও যেখানে ইরান বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ অপরিশোধিত জালানি তেল বা ক্রুড অয়েল উত্তোলনকারী দেশ– সেখানে জ্বালানি বাজারে এধরনের যুদ্ধের প্রভাব সুগভীর হবে, তা সহজেই অনুমেয়। কিছুদিন আগে পর্যন্তও উভয় দেশ সরাসরি সংঘাতকে এড়িয়েই চলেছে। একারণেই গাজায় যুদ্ধ চললেও – তেহরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলাই চালিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। এতে জ্বালানি বাজার প্রথমে কিছুটা অস্থিতিশীল হলেও পরে কমে কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে আসে দাম। এবছরের বেশিরভাগ সময় ধরেই যা বজায় ছিল।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েল। বৈরুতে হিজবুল্লাহর সদর দফতরে করা ওই ভয়াবহ হামলায় হিজবুল্লাহ’র অন্তত এক ডজন শীর্ষ নেতাসহ ইরানের বিপ্লবী গার্ডের এক শীর্ষ জেনারেল নিহত হন। যার জবাব দিতে গত সপ্তাহে ইসরায়েল লক্ষ্য করে ১৮০টির বেশি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এবার ইসরায়েল তার পাল্টা হামলার চালানোর ঘোষণা দিয়েছে।

কখন এই হামলা হয় সে ভয় গ্রাস করেছে সবাইকে, জ্বালানি বাজার এক কথায় ‘সন্ত্রস্ত’। গত সপ্তাহে অপরিশোধিত জ্বালানি বা ক্রুড অয়েলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০ শতাংশ বেড়ে ৭৮ ডলারে পৌঁছেছে। যা গত দুই বছরের মধ্যে এক সপ্তাহে সবচেয়ে বড় দর বাড়ার ঘটনা। গতকাল ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর এক বছরপূর্তিতে তা আবারো বাড়ে।

জ্বালানি রপ্তানি যাদের প্রধান আয়ের উৎস– এমন দেশকে বলা হয় পেট্রোস্টেট। যেমন রাশিয়ার অর্থনীতিতেও পেট্রোলিয়াম রপ্তানির অবদান সুবিশাল। ফলে দেশটি যখন ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে– তখন ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। আবারও একটি প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশের যুদ্ধে জড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। ফলে দরের এই উত্থান কি আবারো ঘটতে পারে? 

দাম কতটা বাড়বে– তা নির্ভর করছে ইসরায়েল প্রত্যাঘাতের কোন পন্থায় যাবে, তার ওপর।  ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থলসহ অন্যান্য সামরিক লক্ষ্যে যদি তারা হামলা করে, এবং তখন উত্তেজনা থিতু করতে ইরানও মাঝারি ধরনের পাল্টা হামলা চালায়— তাহলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে তেলের দরের যেকোনো চড়া উত্থান দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হবে না। কিন্তু, ইসরায়েল ইরানের বেসামরিক অবকাঠামো, তেল ও গ্যাসক্ষেত্র, পরিশোধনাগার বা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সংঘাতকে তীব্রতা দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এইক্ষেত্রে তেহরানও একটি শক্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে, ফলত ইরানের শাসকগোষ্ঠীর লাইফলাইন তেল শিল্প পরিণত হবে ইসরায়েলের স্থায়ী লক্ষ্যবস্তুতে। তখন পেট্রোলিয়াম স্থাপনায় হামলা হোক বা না হোক – বিশ্ববাজারকে তটস্থ করে তুলতে লক্ষ্যবস্তু হওয়াই হবে যথেষ্ট। 

ইসরায়েল যদি ইরানের তেল স্থাপনায় হামলায় সিদ্ধান্ত নেয়– তাহলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনকারী পরিশোধনাগারগুলোয় নিঃসন্দেহে আঘাত করবে। এরকম সম্ভাব্য একটি লক্ষ্য হতে হতে পারে– শতবর্ষী আবাদান রিফাইনারি, যেখান থেকে ইরানের স্থানীয় জ্বালানি তেল চাহিদার ১৩ শতাংশ পূরণ করা হয়। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাজারের সরবরাহ পূরণে– ইরাকের কুর্দিস্তান থেকে চোরাইপথে জ্বালানি কিনতে পারে তেহরান। এমন অনুমানের কথা জানিয়েছে বাজার তথ্য পরিবেশক আন্তর্জাতিক সংস্থা কেপলার। অর্থাৎ, আবাদানে হামলা হলে জ্বালানি সরবরাহের সমস্যা ইরানের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে থাকবে, এমনকী এতে করে বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েল সরবরাহ বাড়তেও পারে– কারণ সেক্ষেত্রে ইরান অপরিশোধিত থাকা তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানির চেষ্টা করবে। 

আবার ইসরায়েল যদি ইরানের জ্বালানি রপ্তানি সক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়— তাহলে পারস্য উপসাগরের খার্গ দ্বীপে অবস্থিত ইরানি তেল টার্মিনালগুলোয় হামলা করতে পারে— যার মাধ্যমে ইরানের ১০ ভাগের ৯ ভাগ অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) জাহাজীকরণ করা হয়। অথবা সরাসরি ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতেও হতে পারে বোমাবর্ষণ। 

তেল আবিব এই পথে হাঁটলে তার রাজনৈতিক মূল্যও দিতে হবে। জ্বালানি তেলের দর বাড়লে নাখোশ হন আমেরিকান ভোটাররা। সামনে নভেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার মাত্র এক মাস আগে এই ধরনের হামলায় বেজার হবে বাইডেন প্রশাসন। আবার ইরানের অধিকাংশ জ্বালানি তেলের ক্রেতা চীনকেও ক্ষুদ্ধ করবে এই পদক্ষেপ। ইসরায়েলের জন্য সেটাও চিন্তার কারণ, কারণ তাদের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হাইফা পোর্ট– পরিচালনার পাশাপাশি দেশটির প্রযুক্তি খাতের বড় বিনিয়োগকারীও চীন। 

তারপরেও এসমস্ত কূটনৈতিক মূল্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তেল আবিব তেলের টার্মিনালগুলোকে নিশানা করতে পারে। সেখানে একটি সফল হামলার ফলে বিশ্ববাজারের সরবরাহ ব্যবস্থার বাইরে চলে যাবে বিপুল পরিমাণ জ্বালানির জোগান। গত মাসে ইরান প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল রপ্তানি করেছে, যা ছিল বিশ্বের মোট সরবরাহের ২ শতাংশ। 

সরবরাহের এই পতন তবু হয়তো সামাল দেওয়া যাবে।মহামারির পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যখন চলছিল– তখন তুঙ্গে পৌঁছায় তেলের চাহিদা, পাল্লা দিয়ে বাড়ে উত্তোলন। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই পুনরুদ্ধার শ্লথ হয়ে পড়ে, ফলে অর্থনীতিতে কমে যায় জ্বালানি তেলের চাহিদা। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদনও অনেকটাই কমিয়েছে— তেল উৎপাদক দেশগুলোর জোট ওপেক জোট প্লাসের সদস্যরা। কিন্তু, সম্মিলিতভাবে তারা দৈনিক অতিরিক্ত ৫০ লাখ ব্যারেল সরবরাহের সক্ষমতা রাখে। ইরানের ২০ লাখ ব্যারেলের ঘাটতি পূরণে যা যথেষ্টের চেয়েও বেশি। এছাড়া, কেবল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক রিজার্ভেই থাকে ৪০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল। 
 
ইরানের মতো বাজার প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে– এ দুটি দেশ কিন্তু ওপেক প্লাসের অন্যান্য সদস্যের মুখাপেক্ষী হয়ে অপেক্ষা করবে না, বরং সাথেসাথেই নিজেদের রপ্তানি বাড়াবে। দীর্ঘসময় ধরে তারা উৎপাদন হ্রাস করেছিল– যেকারণে এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষাতেই তারা আছে। গত মাসেই তারা এবছরের ডিসেম্বর থেকে তেলের উত্তোলন দৈনিক ১ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্ত না মেনেই গত কয়েক মাস ধরে তাদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সরবরাহ করেছে ইরাক ও কাজাখস্তান। ওপেক প্লাসের জোটগত শৃঙ্খলা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে, এই অবস্থায় শুধু সৌদি বা আমিরাত নয়– অন্যান্য প্রধান প্রধান উৎপাদনকারীও বাজারের হিস্যা দখলে রপ্তানি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

আমেরিকা, গায়ানা, ব্রাজিলসহ বিশ্বের অন্যত্রও বাড়ছে জ্বালানি তেলের উৎপাদন (উত্তোলন)। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার প্রত্যাশামতে, আগামী বছরে ওপেক সদস্য নয় এমন দেশগুলোর উৎপাদন দৈনিক ১৫ লাখ ব্যারেলে পৌঁছাবে। যাতে করে তেলের বৈশ্বিক চাহিদা হঠাৎ বাড়লেও তা সামাল দেওয়া যাবে। সহসা সেই সম্ভাবনা অবশ্য নেই, আমেরিকা, চীন ও ইউরোপের মতো প্রধান অর্থনীতিগুলোয় প্রবৃদ্ধি মন্থর, একইসঙ্গে তারা জীবাশ্ম জ্বালানির যানবাহনের বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার ও উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে। 

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির আগে জ্বালানি ব্যবসায়ীরা ২০২৫ সালে তেলের চাহিদায় একটি বড় ধসের আশঙ্কাও করেছিলেন, যার ফলে দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের নিচে চলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছিল। অধিকাংশ ধনী দেশের জোট – ওইসিডির সদস্যদের বর্তমান অপরিশোধিত জ্বালানির মজুদ তাঁদের পাঁচ বছরের গড়ের চেয়েও কম। তাই খার্গ দ্বীপে ইসরায়েলি হামলা জ্বালানি তেলের বাজারকে আন্দোলিত করলেও – তাতে করে দাম বর্তমান অবস্থানের চেয়ে ৫-১০ ডলার পর্যন্তই শুধু বাড়বে।  

তবে পারস্য উপসাগর তীরের আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে সাহায্য করছে– এমনটা দেখলে ইরান তাদের তেলশিল্পে আঘাত হানতে পারে। সৌদির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরেও রিয়াদ-তেহরান আঞ্চলিক উত্তেজনা খুব একটা থিতু হয়নি। উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের পশ্চিমাঘেঁষা শাসকদের কারণে তাদের ব্যাপারে ইরান বরাবরাই সন্দিহান। এই অবস্থায়, ইসরায়েলকে সহযোগিতা করা হবে না বলে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানকে আশ্বস্তও করেছেন উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর কূটনীতিকরা। কিন্তু, আশ্বাস শেষকথা নয়, শেষপর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় যদি তারা সাহায্য করেছে বলে ইরানের মনে হয়– তাহলে প্রতিবেশীদের তেলশিল্পকেও ছাড় দেবে না। শুরুটা হতে পারে কুয়েত ও বাহরাইনের জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলার মধ্যে দিয়ে। 

বিশ্বের জ্বালানি বাজারের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাতে হরমুজ প্রণালীও বন্ধ করে দিতে পারে ইরান, সমুদ্রপথে রপ্তানি করা ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এই জলপথ দিয়ে যায়। মোট গ্যাস রপ্তানির ২০ শতাংশও এই নৌপথ দিয়ে রপ্তানি হয়। তবে ইরানের জন্য এ পদক্ষেপ হতে পারে আত্মঘাতী। কারণ তাতে শুধু তাঁদের জ্বালানি রপ্তানি বন্ধ হবে না, একইসঙ্গে দরকারি অনেক আমদানি পণ্য আনাও সম্ভব হবে না। বেইজিং এতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হবে, কারণ হরমুজ প্রণালী দিয়েই চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার চাহিদার অর্ধেক ক্রুড অয়েল আমদানি করে থাকে। ফলে ইরান এই পথে যাবে এমনটা নিশ্চিত নয়।

কিন্তু, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ দিকে যদি মোড় নেয়– তাহলে বিশ্ববাজার কোনদিকে যাবে তা বলা মুশকিল। কারণ, ইরানের এই পদক্ষেপের পর আমেরিকা, ইসরায়েল ও তাদের পশ্চিমা মিত্র ও অন্যান্য বিশ্বশক্তিও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। যেমন হরমুজ প্রণালী পুনঃউন্মুক্ত করতে নিজেদের নৌবাহিনী পাঠাতে পারে চীন ও আমেরিকা। তাতেও ট্যাংকার জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বিপদমুক্ত হবে না, এই ধরনের অনিশ্চয়তার ডামাডোলে অপরিশোধিত তেলের দাম এতোটা বাড়তে পারে যে– এই জ্বালানির চাহিদাতেই তা ধস নামাতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ক্রুডের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩০ ডলারে পৌঁছালেও– চাহিদার এমন পতনের সূচনা হবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button