Hot

মরণ নেশা অনলাইন জুয়া, স্মার্টফোনে ‘জুয়ায় বাজি’ ধরে সর্বস্বান্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ

ডিজিটালাইজেশনের যুগে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে দেশের মানুষ। স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইনে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার বাজি ধরা হচ্ছে। ডিজিটাল যুগে এই ভাল কাজের ব্যবহারের মতো মন্দ কাজ তথা খারাপ কাজেও ব্যবহার করছে এক শ্রেণির অপরাধী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন অনলাইন জুয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। ফলে ডিজিটালে যেমন সুবিধা ভোগ করছে তেমন অপরাধের ঘটনাও ঘটছে। ক্যাসিনো, সাধারণ জুয়া খেলার চেয়েও এই অনলাইন জুয়ার বাজি আরো বেশি ভয়ঙ্কর। প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেখানে সেখানে থেকে এই জুয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার লাখ লাখ ডলার লেনদেন হচ্ছে। এতে অপরাধীরা ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের মধ্যে জুয়ার নেশা ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন বাজির মরণ খেলায়। জুয়ার নেশায় বুদ হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকে। কেউ আবার বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। এমনকি প্রভাবশালী পরিবার, পাবলিক সেলিব্রেটিরাও এই অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। অনলাইনে এই জুয়া খেলা হওয়ায় রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও এই ‘অপরাধ খেলা’ ছড়িয়ে পড়েছে।

তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান অনলাইনে জুয়ার ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে মন্ট্রিয়াল টাইগার্সের হয়ে খেলেছিলেন সাকিব। ওই দলের অফিসিয়াল পার্টনার ছিল অনলাইন জুয়ার ‘বাবু৮৮’ নামের এই সাইটটি। ২০২২ সালে অনলাইন জুয়ার সাইট বেটউইনারের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন সাকিব আল হাসান। শুধু কি তাই! গত বছর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ছোট বোন জান্নাতুল হাসান ‘১১রিপশবঃ.পড়স’ নামে একটি অনলাইন বেটিং (অনলাইনে বাজি ধরা) অ্যাপে বিনিয়োগ করেছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তদন্তে এ চিত্র উঠে আসে।

অলরাউণ্ড ক্রিকেটারের বোন জান্নাতুল হাসানের মতো দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ কৌতূহলের বশে এই অনলাইন জুয়ার বাজি ধরা শুরু করে এখন পেশাদার জুয়ার বাজিগর হয়ে গেছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অনলাইন জুয়ার বাজি ধরার ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, ক্যাসিনো, সাধারণ জুয়ার মতো অপরাধ কাণ্ড অনলাইন জুয়ার অপরাধের কাছে শিশু অপরাধ। সারাদেশে এই ডিজিটাল অপরাধ অনলাইন জুয়া শহর থেকে ছড়িয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই এই অনলাইন জুয়ায় বাজি ধরার অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে করে অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়ে গেছে।

অনলাইন জুয়ার বাজি ধরার অপরাধ সমাজে নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কৌতূহলী তরুণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। অনলাইন জুয়ায় প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সাধারণ মানুষ পাঁচ-দশ হাজার টাকায় জুয়া শুরু করে লোভে পড়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আসক্তদের মধ্যে অনেকেই ঋণ করে জুয়ায় হেরে আত্মহত্যাও করছেন। সঠিক আইন ও তথ্য না থাকায় অনলাইন জুয়া পরিচালনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না আইন-শৃংখলা বাহিনী। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারানোর কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। জুয়ার টাকা জোগাড় করতে কেউ নেমে পড়েছেন খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতায়। ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে ধনী-গরিব, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, দিনমজুর, শিক্ষিত বেকার কে নেই এই নেশায়। আবাসিক হোটেল, বাসা-বাড়ি, রেস্টহাউস, গেস্টহাউস থেকে শুরু করে ভাতের হোটেলেও অনলাইন জুয়ার আসর বসছে।

অনলাইন জুয়ার সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। বর্তমানে যখন দেশে ডলার সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে তখন জুয়ার বিনিয়োগ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যম ছাড়াও লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও অন্যান্য মাধ্যমেও পেমেন্ট করছে জুয়াড়িরা। অনলাইনে জুয়ায় ছোট ছোট বাজির টাকা দিন শেষে একটি বড় অঙ্কের অর্থ হয়ে দেশ থেকে ডলারের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে প্রতিদিন। জুয়ার অ্যাপস নিয়ন্ত্রকরা বিদেশে বসে বাংলাদেশে নিযুক্ত স্থানীয় সিন্ডিকেট ও এজেন্টদের মাধ্যমে এ টাকা ডলারে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ হয়েছে কোটি টাকার মালিক। প্রতিদিন ৩০০ সাইটে বাংলাদেশিরা অনলাইনে জুয়া খেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন জুয়া একটা নেশার মতো, এখানে একবার ঢুকলে নিঃস্ব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অংশগ্রহণকারীরা নিঃস্ব হওয়ায় পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে, আইন-শৃঙ্খলার ওপর প্রভাব পড়ছে। সময়োপযোগী আইন করার পাশাপাশি পুলিশের মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। মোবাইল ও টেকনোলজির সহজলভ্যতায় মানুষ খুব সহজেই জুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এর পেছনে দুটি চক্র জড়িত। একটি জুয়ার এজেন্ট অন্যটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট। এজেন্ট ছাড়া কেউ জুয়া খেলতে পারে না। অর্থাৎ, টাকা লেনদেন সম্ভব নয়। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে যদি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট নম্বর ব্যবহার না হয় তাহলে অনেকাংশে অনলাইন জুয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

অনলাইনে জুয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন চান পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রকাশ্যে সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে জুয়া খেলা হলে ১৮৬৭ সালের পাবলিক জুয়া আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু অনলাইন জুয়ার আইনে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। পুলিশ সপ্তাহ-২০২৪ এর পঞ্চম দিনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে তিন মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই আইন তৈরি হয়নি।

আইন-শৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, জুয়ার পুরো বিষয়গুলোই চলে অনলাইনে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউক্রেনের ওয়েবসাইট বাইনানি ডটকম, বাইনানি টুয়েন্টিফোর ডটকম, বাইনানি, প্রোফি আইকিউ, বাইনানি গো অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন প্লাটফর্মে মেল বেট, ওয়ান এক্সবেট ও বেট উইনার নামের বেটিং সাইট চালিয়ে কোটি-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। ওয়ান এক্স বেট অনলাইন জুয়ার সাইট। কিন্তু বিজ্ঞাপনে নাম দেখানো হচ্ছে ওয়ান এক্সব্যাট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এসব জুয়ার মালিক কারা বা কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই। এসব অ্যাপের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কারিগরি সক্ষমতার অভাব রয়েছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের। তারা বলছে, বিদেশ থেকে অনলাইন জুয়া পরিচালিত হওয়ায় এগুলো ঠেকানো সহজ নয়। কয়েকটি জুয়ার ফেসবুক পেজে দেওয়া রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। এগুলোতে যোগাযোগ করেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং টাকার বিনিময়ে গ্রুপের সদস্য হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। চাওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, বয়স, জন্ম তারিখ ও মোবাইল ফোন নম্বর। এসব তথ্য দিলেই মেলে গ্রুপের সদস্য হওয়ার অনুমতি। অনলাইন জুয়ায় দেশে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এর একটি বড় অংশ পাচার হচ্ছে বিদেশে। দেশের প্রভাবশালীদের মধ্যে অনেকেই অনলাইন জুয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য থাকলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন ওই প্রভাবশালীরা। অনলাইন থেকে আয়ের সব টাকাও তারা (প্রভাবশালীরা) পাচার করছেন দেশের বাইরে।

গত ৯ মে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সদস্য এম আবদুল লতিফের এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, অনলাইন জুয়া, হুন্ডি প্রভৃতি কারণে মুদ্রাপাচার বেড়ে যাওয়ায় দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ও ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেনের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিগত এই উন্নয়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু চক্র অনলাইন জুয়া-বেটিং, গেমিং, ফরেন ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও হুন্ডি প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ হতে মুদ্রাপাচার বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনলাইন জুয়া/বেটিং ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার রোধসহ সব ধরনের অর্থপাচার রোধকল্পে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন জুয়া/বেটিং এবং হুন্ডির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৫৮৬টি ব্যক্তিগত এমএফএস হিসাব বিএফআইইউ কর্তৃক স্থগিত করা হয়েছে।

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় প্রকাশ্যে খেলা হলেও আশপাশের মানুষ তা বুঝতে পারেন না। জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই স্মার্টফোন রয়েছে। যাদের নেই, তারা দিনের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় স্মার্টফোন ভাড়া নিতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম অংশগ্রহণকারীদের জুয়ায় জিতিয়ে লোভে ফেলা হয়। এরপর নেশা ধরে গেলে একের পর এক টাকা খোয়ানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন আর বের হওয়ার পথ থাকে না।

নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলতেন শুভ (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ওয়ানএক্সবেটে জুয়া খেলতাম। প্রথমে নগদের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাইটে খেলা শুরু করি। এক রাতে পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা লাভ হয়। পরদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় খেলতে গেলে পুরো টাকা হেরে যাই। পরবর্তী সময়ে দুই লাখের মতো ইনভেস্ট করি। সেখানে খেলতে গিয়েও হেরে যাই। বড় অংকের টাকা হেরে গিয়ে পরে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে খেলা শুরু করি। সেখানে অনেক সময় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত লাভ হয়, আবার অনেক সময় পুরো টাকাই হেরে যাই। এটি নেশার মতো। খেলতে শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছা করে। টাকা শেষ হলে আবারও টাকা ইনভেস্ট করে খেলা শুরু করতে ইচ্ছা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ময়মনসিংহের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, তার ছেলে স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কৌশলে টাকা নিয়ে এটা খেলে। কোনোভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। ছেলের ভবিষ্যৎ অনলাইন জুয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।

ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে একাধিক চক্র বিভিন্ন সিক্রেট গ্রুপে জুয়ায় আসক্তদের যুক্ত করে। বিশেষ করে আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের সময় এসব লেনদেন বেড়ে যায়। বেশিরভাগ জুয়া হয় ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে। মানি লন্ডারিং নিয়ে সিআইডি কাজ করলেও অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করছি।
বেটিং অ্যাপে জুয়ার ফাঁদ যে শুধু শহরকেন্দ্রিক তা নয়। শহর ছাপিয়ে তা এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি লোভে পড়ে জুয়ার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে এর আগে র‌্যাব অনেক জুয়াড়িকে আইনের আওতায় এনেছে। পাশাপাশি অনলাইনে জুয়া পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

বালিয়াডাঙ্গীতে জুয়ায় হেরে আত্মহত্যা : ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে রাজিউর রহমান রাজু নামের এক যুবক অনলাইন জুয়ায় টাকা হেরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। গত ৪ মে রাতে শয়ন কক্ষ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। রাজুর স্ত্রী মরজিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, গেল ছয় মাস ধরে অনলাইনে জুয়ায় আসক্ত রাজু। শনিবার দিনভর বাড়িতে ঘরে একা অনলাইনে জুয়া খেলছিল সে। ৭০ হাজার টাকাও ছিল তার কাছে। স্থানীয় বাজার থেকে মোবাইল ব্যাংকিং-এ ব্যালেন্স ভরে ঘরেই ক্যাসিনো খেলছিল। সব টাকা হারিয়ে আত্মহত্যা করে সে।

অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক কর্মকর্তা জানান, অনলাইন জুয়া মনিটর করার কেউ নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিটিআরসি এ পর্যন্ত কয়েক শ’ অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে।

চট্টগ্রামে থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রামে অনলাইন জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকে। কেউ আবার বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। চট্টগ্রামে বনেদী সওদাগরী পাড়া চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ এবং হাজারি গলিতেও ব্যবসার আড়ালে জুয়ায় মত্ত হচ্ছেন কতিপয় ব্যবসায়ী। স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে জড়িয়ে পড়ছে এই মরণ খেলায়। মহানগরীর পাশাপাশি পল্লিগ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে জুয়ার নেশা। এসব আসরে প্রতিদিন ৩-৪ কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

পুলিশ বলছে, যেহেতু বর্তমানে প্রায় সবার হাতে স্মার্টফোন এবং সকলে কমবেশি প্রযুক্তি ব্যবহারে আকৃষ্ট তাই লোভে পড়ে অনেকে অনলাইন জুয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এ ধরনের জুয়ায় আসক্তরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত। এক একটি গ্রুপে বেশ কয়েকজন মিলে জুয়ায় বসে। প্রত্যেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকার জুয়া খেলে। জুয়ার অর্থ ডলার থেকে বাংলাদেশি টাকায় ভাঙ্গিয়ে নেয়া হয়। এ ধরনের জুয়ায় অসংখ্য যুবক ও তাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। সবকিছু হারিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন। গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে পিপলু দে নামে যুবক আত্মহত্যা করেন। নিহত পিপলু দে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনগর এলাকার জগদিশ দে’র ছেলে। জানা যায়, অনলাইন জুয়ায় সব হারিয়ে লোহাগাড়ার বটতলী মোটরস্টেশনের ডা. মাহমুদুর রহমানের ভাড়া বাসায় আত্মহত্যা করেন তিনি। এমন ঘটনা নগরীতে ঘটেছে বেশ কয়েকটি। আবার জুয়ার টাকা জোগাড়, কিংবা জুয়ায় সব হারিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।


Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button