মরুভূমিতে পানির অভাব, অথচ মাটির নিচেই প্রাচীন জলাধার: আফ্রিকায় মরুভূমির নিচে পানির বিশাল ভান্ডার
মরুভূমিতে পানির অভাব, অথচ মাটির নিচেই প্রাচীন জলাধার। সুদানসহ আফ্রিকার বড় কয়েকটি দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ পানির ভান্ডারের অস্তিত্ব রয়েছে। আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সেই পানির সদ্ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
সুদানের যত উত্তরে যাওয়া যায়, সেদিকে জমি ততই শুষ্ক। কয়েক শ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধুই মরুভূমি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও মরুভূমির বালুর স্তূপের নিচে কিন্তু পানির বিশাল ভান্ডার রয়েছে। মিসর, সুদান থেকে চাদ ও লিবিয়া পর্যন্ত সেই জলাধার বিস্তৃত। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে খননের সময় ‘নিউবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার’ নামের সেই ভান্ডার আবিষ্কার করা হয়েছিল।
ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে আবদাল্লাহ ওমর ২০ বছর ধরে অ্যাকুইফার নিয়ে গবেষণা করছেন। কয়েকটি জায়গায় ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি পানির নাগাল পাওয়া যায়৷ ২০০৪ সালে খননের সময় ওমর এল গা-আব অঞ্চলে পানির একটি উৎস খুলে দেন।
ওমর বলেন, ‘সুদানের উত্তরের অংশে গভীরতা ৬০ মিটার অথবা আরও কম। ভাবতে পারেন? একটি সেচ প্রণালি দিয়ে ৫০ হেক্টর জমিতে সেচ করা সম্ভব। সেটা সত্যি অনন্য এক বিষয়। এতে জলাধারের শক্তিশালী প্রবাহ স্পষ্ট হয়ে যায়।’
গা-আব এল-হাশার মতো মরুভূমির গ্রাম এই বিশাল পানির ভান্ডারের কারণে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে। ২০ বছর আগে সেই উৎস আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ নিয়মিত পানির নাগাল পাচ্ছে।
আবদুল হাফিজ সাইদের মতো চাষি সেই সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছেন৷ তাঁর নিজস্ব কয়েক শ হেক্টর খেতে তিনি নানা ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করছেন৷ ফাভা বিনস, জোয়ার এবং আলফালফার পাশাপাশি চলতি বছর তিনি গম উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছেন৷
আবদুল হাফিজ বলেন, ‘কৃষিকাজে পানি ঠিকমতো ব্যবহার করা উচিত। অর্থাৎ আমার মতে, উন্নত পদ্ধতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানির সাশ্রয় করা সম্ভব৷ কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতি ব্যবহার করলে বেশি পানি লাগে৷’
বেশ কয়েক বছর ধরে প্রাচীর গড়ে তোলার সুফল ভোগ করে আবদুল হাফিজ সাইদ নিয়মিত তাঁর খেতে সেচের কাজ করতে পারছেন। প্রতিটি উৎসের জন্য তাঁর প্রায় সাড়ে চার শ ইউরোর মতো ব্যয় করতে হয়৷ কিন্তু তারপর গ্রামবাসী ও চাষিরা বিনা মূল্যে পানি পেতে পারেন।
‘নিউবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘জীবাশ্ম’ জলাধার। অর্থাৎ কয়েক লাখ বছর আগে সেখানে পানি জমা হয়ে মাটির নিচে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু অ্যাকুইফারের পানির ভান্ডার মোটেই অফুরন্ত নয়৷ কয়েকটি জায়গায় কম হলেও নতুন করে পানি আসে৷ অন্য জায়গায় একেবারেই সেই রকম আসে না৷
কয়েকজন গবেষকের ধারণা, অ্যাকুইফারের এই পানি কমপক্ষে আরও দুই শ বছর টিকে থাকতে পারে৷ তবে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ তা ছাড়া সময়টাও বেশি নয়৷ এক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও জাতিসংঘের এক প্রকল্পের মাধ্যমে সেই পানি ন্যায্য ও টেকসই উপায়ে ব্যবহার করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে৷
সুদান সরকার ২০২২ সালে পানির ব্যবহারসংক্রান্ত একটি আইনে সম্মতি জানিয়েছিল৷ সেচ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সেটি কার্যকর করার কথা৷ এ পর্যন্ত সরকার জনগণের জন্য ৩৮টি ছোট ও ছয়টি গভীর কূপ তৈরি করেছে৷
মন্ত্রণালয়ের পানি বিশেষজ্ঞ ওসমান আহমেদ বলেন, ‘আমরা দেশের উত্তরে ও নীলনদের কাছের প্রদেশগুলোতে গম উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছি৷ আমরা গবেষণায় তথ্য পেয়েছি, অ্যাকুইফারের পানি ব্যবহার করে ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে গম উৎপাদন করতে পারি৷ পানির স্তর না কমিয়ে বা অ্যাকুইফারের ক্ষতি না করেই সেটা সম্ভব।’
এ পর্যন্ত অ্যাকুইফারে জমা বিশাল পরিমাণ পানি অন্তত কাগজে-কলমে কমেনি৷ পানি সহজে মিলছে বলে গোটা অঞ্চলের জনসংখ্যা এবং সেই সঙ্গে চাষি ও পশুপালকদের সংখ্যাও বাড়ছে৷
ভূতত্ত্ববিদ আবদাল্লাহ ওমর নিয়মিত উত্তরের প্রদেশগুলোর গ্রামে গিয়ে পানির ব্যবহারের ওপর নজর রাখেন৷ তিনি বলেন, ‘গোটা উত্তর প্রদেশে ১১টি ডিভাইস ছড়িয়ে রয়েছে, যেগুলোর পানির স্তরে পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রাখার কথা৷’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে মরুকরণ বাড়ছে তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এই অঞ্চলে অতীতের তুলনায় পানির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে৷ বিশাল অ্যাকুইফারের জীবাশ্ম পানি যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগানো যায়, তাহলে সেখানে মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করা অনেক সহজ হবে।