Hot

মশা নিয়ন্ত্রণে শুধুই লোক দেখানো কার্যক্রম?

এক সময় গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনে মশার ওষুধ সরবরাহ করত। সিন্ডিকেট করে তারা নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ তো করতই, ওষুধের নামে ড্রামে পানি ভরে গছিয়ে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। এসব হয়েছে সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘ম্যানেজ করে’।

মশার ওষুধ সরবরাহে জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ঘোষণা দেয়– ‘সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে, আর কেউ ডিএনসিসিকে যা-তা গছিয়ে দিতে পারবে না।’ ওষুধ আমদানির শর্তও শিথিল করে ডিএনসিসি। এতে নগরবাসী আশ্বস্ত হয়– আর হয়তো মশার ওষুধে ভেজাল থাকবে না, নির্ভেজাল ওষুধে মশার মরণ অনিবার্য। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া মহামারি রূপ নেবে না। স্বস্তিতে ঘুমানো যাবে। কিন্তু সে আশায় ‘গুড়ে বালি’!

মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করতে ২০২১ সালে ড্রোন ব্যবহার শুরু করে ডিএনসিসি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চালু করে ‘ব্যাঙ থেরাপি’ অর্থাৎ ব্যাঙ দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম। এ ছাড়া মশা নিধনে জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট, গাপ্পি মাছ ও হাঁস ছাড়ার ঘটনাও দেখেছে নগরবাসী।

গত জানুয়ারিতে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণে ফ্লোরিডার মায়ামিতে যায় তারা। সেখানে অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর গত ২০ জানুয়ারি মায়ামি থেকে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে। সে কারণে মশার লার্ভা ধ্বংস হয়নি বরং বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। মায়ামির ল্যাবরেটরিতে মশার প্রজাতি নির্ণয় করে বাসিলাস টুরিংজেনেসিস ইসরাইলেনসিস (বিটিআই) দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মায়ামির সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়ার মিল রয়েছে। তাই বিটিআই দিয়ে ঢাকায় মশা নিধন করা হবে।’

এরপর শুরু হয় বিটিআই আমদানি কার্যক্রম। গত জুলাইয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানির ঘোষণা দেয় ডিএনসিসি। দ্রুতই ৫ টন বিটিআই আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মার্শাল এগ্রোভেট লিমিটেড’। যদিও ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অপরাধে এক সময় প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল ডিএনসিসি।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের উপস্থিতিতে নগর ভবনে বিটিআই ব্যবহারের মহড়া হয়। লি ঝিয়াং নামে এক ব্যক্তিকে হাজির করে বলা হয়, তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং বিটিআই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘বেস্ট কেমিক্যালস’-এর প্রতিনিধি। ওষুধ প্রয়োগের কলাকৌশল শেখাবেন তিনি। ঠিক যখন মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ শুরুর কথা, তখনই ধরা পড়ে– সিঙ্গাপুর থেকে নয়, ওই বিটিআই এসেছে চীন থেকে। মার্শাল এগ্রো জালিয়াতি করে ডিএনসিসির কাছে গছিয়েছে পণ্যটি। আর লি ঝিয়াং সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানির কেউ নন, তিনি আসলে চীনা, নাম জনি লি। অপরদিকে, ‘বেস্ট কেমিক্যালস’ তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, মার্শাল এগ্রোভেট বা ডিএনসিসিকে তারা বিটিআই সরবরাহ করেনি।

তাছাড়া, বিটিআই সরবরাহ করার জন্য কীটনাশক আমদানিতে তিন বছরের অভিজ্ঞতা, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের নিবন্ধন বা বিশেষ অনুমতি সনদ, আইইডিসিআরের বায়ো-এফিশিয়েন্সি রিপোর্ট এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিলের যে শর্ত আছে– তার কিছুই নেই মার্শাল এগ্রোভেটের।

ডিএনসিসি তখন বলে, ‘ওষুধ ভেজাল হলে সরবরাহকারীকে বিল দেওয়া হবে না।’ ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের কমিটি। ওই কমিটির রিপোর্ট এখনও জমা হয়নি। কমিটির প্রধান ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএ শরিফ উদ্দিন আরও সময় প্রার্থনা করে চলে গেছেন পোল্যান্ড, রাস্তার বাতি কেনার কাজে।

তখন প্রশ্ন ওঠে, আমদানি এসব বিটিআইর কী হবে। ডিএনসিসি বলে, চীন থেকে আমদানি হলেও সমস্যা নেই, মান ভালো থাকলে সেগুলো প্রয়োগ করা হবে। খামারবাড়ীর প্লান্ট প্রোটেকশন উইংয়ে (পিপিডব্লিউ) পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়। তারা জানায়, ‘এই কীটনাশকে উদ্ভিদের ক্ষতি হয় না। তবে আরও দুটি পরীক্ষা বাকি।’

মশক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নিবন্ধিত কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি হলে বিটিআইর ওই প্যাকেটে কী আছে, তা জানা যেত। কিন্তু সিটি করপোরেশন এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করে, যাতে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান বিটিআই সরবরাহের কাজটি পায়।’ তিনি বলেন, ‘অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে বিটিআই আমদানি করে। তবে তারা যাতে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে আমদানির শর্ত দেওয়া হয়েছিল টেন্ডারে। সিটি করপোরেশনের লোক জড়িত না থাকলে ঠিকাদার এমন জালিয়াতি করতে পারেন না।’ ভুল পরামর্শে মশা নয়, সিটি করপোরেশন মানুষ মারছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পুরো ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করা উচিত বলেও মনে করেন।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী সেলিম রেজা বলেন, ‘মশক নিধনে বিটিআই আমদানি একটি ভালো উদ্যোগ ছিল; কিন্তু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কালো তালিকাভুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। তা ছাড়া, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিল কিনা, সে বিষয়ে টেন্ডার কমিটি একটি রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা বিশেষজ্ঞ দিয়ে সেটি যাচাই করে দেখব। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, আর টেন্ডারে নয়, ভবিষ্যতে সরাসরি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে কীটনাশক আমদানি করবে ডিএনসিসি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ আবু ফয়েজ মোহাম্মদ আসলাম বলেন, ‘মার্শাল এগ্রোভেটের সরবরাহ করা বিটিআইর প্যাকেটে ম্যানুফ্যাকচার তারিখ ও হটলাইন নম্বর নেই। তাতে কী কী উপাদান আছে, তাও নেই। এমনকি রেজিস্ট্রেশন নম্বরও নেই। এগুলো যাচাই-বাছাই না করেই পণ্যটি বুঝে নেওয়া হয়। সে কারণেই ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশের প্রশ্ন আসে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা (ডিএনসিসি) যে কীটনাশক ব্যবহার করছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ আছে। কারণ ওষুধের মান ঠিক থাকলে মশার মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা হচ্ছে না। তাই মনে হয় না তারা মশা নিধনে আন্তরিক!’

সফলতা-ব্যর্থতা জনগণ বিচার করুক: মেয়র আতিকুল

মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা-ব্যর্থতা বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত শনিবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজে আলোচনা সভা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসি সফল নাকি ব্যর্থ, সেই বিচার জনগণ করুক। সিটি করপোরেশন যে সক্রিয় রয়েছে, জনগণ তা দেখছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বসে নেই, মশক নিধনে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছি। জনগণকে সম্পৃক্ত করছি, সচেতনতা বাড়াচ্ছি। মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। শিশুদের সচেতনতামূলক কার্টুন বই দিচ্ছি। ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে সবার ঢাকা অ্যাপস ও ফেসবুক পেজে এলাকাভিত্তিক মশক কর্মীর তালিকা দেওয়া আছে। সবাই সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d