Bangladesh

মশা মারতে ‘কামান দাগাচ্ছে’ না কেউ

ডেঙ্গু মৌসুম ঘিরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নানা কর্মসূচি নিয়ে সামনে এলেও এবার মশা মারতে কামান দাগাচ্ছে না কেউ! প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে রাজধানী তো বটেই, সবখানে এখন মশার রাজত্ব। মশক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর তালিকাও হচ্ছে দীর্ঘ।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি পালিয়ে থাকায় গেল এক মাস মশক নিধন কার্যক্রম কার্যত লাটে উঠেছে। মাঠ পর্যায়ে অনেকেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। ফলে এডিস মশার ‘হটস্পট’ বিষয়ক কোনো তথ্য তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে আসছে না। যাদের মাধ্যমে এ তথ্য কেন্দ্রে আসার কথা, সেই জনপ্রতিনিধিরা রাজনৈতিক কারণে কর্মস্থলেই যাচ্ছেন না। এর মধ্যে আবার পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সব শীর্ষ জনপ্রতিনিধিকে পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এদিকে, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরকে এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় চিহ্নিত করা হয়। বর্ষার শেষ সময়ে এসে মাঝেমধ্যেই নামছে ঝুম বৃষ্টি। এতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের চেয়ে এবার আরও ভয়ংকর চেহারায় দেখা যেতে পারে ডেঙ্গু।
মশক বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এখনকার এডিস মশার ঘনত্ব থেকেই বোঝা যায়, গত দুই-এক মাস মশক নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজই হয়নি। পাশাপাশি সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। 
এতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। এখনই হটস্পট চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এবার ডেঙ্গু আরও বিপদে ফেলবে।’ 

মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শূন্য
ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়াটা রেওয়াজ। লিফলেট বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবককে এক সুতায় গেঁথে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান, মসজিদে নামাজের পর ইমামের সচেতনতামূলক বয়ান, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি করে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে প্রচারণা, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতো। জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ার পর এসব কার্যক্রম খেই হারিয়েছে। সম্প্রচার মাধ্যমে দুয়েকবার প্রচারণা চালানো হলেও তা যৎসামান্য। 

এদিকে, শেষ দুই মাসে শুধু গত রোববার ডেঙ্গুবিষয়ক একটি সভা স্থানীয় সরকার বিভাগে হয়েছে। সেখানে শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সংস্থা দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সংখ্যাও আগের সময়ের চেয়ে অনেকটা কম। অবশ্য ওই বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ জানিয়েছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত বছর এদিনে ডেঙ্গুতে সাতজনের মৃত্যু হয়েছিল। এবার একই দিনে মারা গেছেন মাত্র একজন। পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার মসজিদ-মন্দির-উপাসনালয়ে প্রার্থনার পর সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

নির্দেশিকা-সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নেই
২০২১ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রণীত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকায় এ রোগ ঠেকানোর সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া আছে। সে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে পৌরসভা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের এডিস মশার ঘনত্ব, ঝুঁকি ও তাদের চাহিদাপত্র প্রতি মাসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করার কথা জনপ্রতিনিধির। অতীতেও তৃণমূল থেকে খুব একটা বেশি তথ্য আসত না। গত দুই মাস তৃণমূল তো বটেই, বিভাগীয় পর্যায় থেকেও কোনো তথ্য আসেনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে পালানোর পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোনো জনপ্রতিনিধিই কর্মস্থলে নেই। মাঠ পর্যায়ের তথ্য অন্ধকারে থাকায় ডেঙ্গু আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
কীটতত্ত্ববিদ ড. ইন্দ্রানী ধর বলেন, জনপ্রতিনিধিরা যেহেতু কর্মস্থলে নেই, সে কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও সিভিল সার্জনের মাধ্যমে তথ্য আনা গেলে মাঠ পরিস্থিতি বোঝা যাবে। সেভাবে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালানো গেলে কিছুটা সহায়তা হতে পারে। এ ছাড়া একটা দ্রুত প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে, যার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে কাজ করা যেতে পারে। 

সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে ঢাকা
এ বছর গতকাল সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে ১৬ হাজার ২৮৫ জনকে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। মারা গেছেন ৯৭ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ৬৭ জন। যদিও প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কাউন্সিলররা আগে মশার ওষুধের চাহিদাপত্র দিতেন প্রয়োজন অনুযায়ী। কাউন্সিলররা আত্মগোপনে থাকায় সেটা দিতে পারছেন না। অনেক কাউন্সিলর অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর-তছনছও করা হয়েছে কোনো কোনো অফিস। অনেক কাউন্সিলর কার্যালয়ে এখনও তালা ঝুলছে। মশককর্মীরা সেখান থেকে ওষুধ পাচ্ছেন না। আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হলেও অতীতের মতো অসাধু মশককর্মীরা সেই ওষুধ কীটনাশকের দোকানে দেদার বিক্রি করে দিচ্ছেন। মশক নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত ওষুধের পর্যাপ্ত মজুত নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সিটি করপোরেশনগুলো নিজস্ব উদ্যোগে ওষুধ কেনার কার্যক্রম হাতে নিলেও এখন তা প্রায় বন্ধ রয়েছে।
অবশ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ওষুধের সংকট নেই। পাঁচ মাসের ওষুধ জমা আছে। জলাশয়ে ব্যবহারের নোভালরুন ট্যাবলেটও আছে। আর ম্যালেরিয়া অয়েল তাৎক্ষণিকভাবে পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করা যায়। 

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই মাসের মধ্যে কোনো জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে বলে সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ জানাতে পারেননি। একইভাবে উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো জলাশয়ের ঝোপঝাড়ও পরিষ্কার করা হয়নি। এ সময়ে সকাল-সন্ধ্যা লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করতেও মশককর্মীদের কালেভদ্রে দেখেছেন নগরবাসী। মশার ডিমপাড়ার মতো পাত্রগুলোও ধ্বংস করা হয়নি; বরং মশক প্রতিরোধের গত ১৭ জানুয়ারির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, থানাগুলোতে আটক যানবাহনের মধ্যে যাতে পানি জমে মশার প্রজননস্থল তৈরি না হয়, সে কারণে ত্রিপল দিয়ে সেগুলো যেন ঢেকে রাখা হয়। ৫ আগস্ট ঘিরে থানা ভবন ও ভেতরে থাকা গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়ায় সেসব থানা কম্পাউন্ড পুরোটা এখন মশার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। 

ঢাকাতেই কার্যক্রম ঠনঠন
ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটবদলের পর থেকে গতি হারিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গুর লার্ভা নিধনের বিশেষ অভিযান। পাড়া, মহল্লা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলরের সমন্বয়ে নেই কোনো প্রচার কার্যক্রম। ডিএনসিসির চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক আর ডাবের খোসার কেনার কার্যক্রমও বন্ধ। মশা নিয়ন্ত্রণে ড্রোন, ব্যাঙ, হাঁস আর গাপ্পি মাছের ব্যবহারও নেই। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজার, সদরঘাট, কলতাবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় নিয়মিত লার্ভিসাইডিং ও ফগিং কার্যক্রম এখন আর নেই। এ এলাকার ৩৬, ৩৭ ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা ছাত্র হত্যা মামলার আসামি। দুই সিটি করপোরেশনে বিগত নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ১৬ কাউন্সিলরই কার্যত মাঠে আছেন। এর মধ্যে ছয়জন আবার সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর।
লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা জুনায়েদ আহমেদ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে বৃষ্টিতে পানি জমছে। তবে মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রমও এখন নেই।’

গুলশান-১-এর ১৩ নম্বর রোডের বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘গেল এক মাসে এ এলাকায় দু’দিনও মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। এ কয়েক দিনে মশার উৎপাতও বেড়েছে কয়েক গুণ। আশপাশে বেশ কয়েকটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। আগে মাঝেমধ্যেই এ ধরনের ভবনে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হতো। সেখানে ওষুধও ছিটানো হচ্ছে না।’
মিরপুরের বাসিন্দা উজ্জ্বল শিকদার বলেন, ‘মশককর্মীরা এমনিতেই ফাঁকি দেন। এর মধ্যে কাউন্সিলররা এখন থেকেও যেন নেই। এ কারণে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।’ 
দুই সিটি করপোরেশনে মশক নিধন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে বলা হলেও সরেজমিন গুলশান, মহাখালী, শেওড়াপাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে কোনো মশককর্মীকে মাঠে পাওয়া যায়নি। 

বাংলামটর, পল্টন, জুরাইন, পুরান ঢাকা, মগবাজার, গুলশান-২, রামপুরা, কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব এলাকাতেও মশককর্মীরা সক্রিয় নন। কাউন্সিলরের অনুপস্থিতিতে ডিএনসিসি গত ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতায় ১০টি অঞ্চলে টিম গঠন করলেও সেই টিমের কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এ বিষয়ক কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি এ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ড. মহা শের আলী সমকালকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে মশকবাহিত রোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা হয়েছে। সভায় উপদেষ্টা মশক নিধনে নির্দেশনা দিয়েছেন। সিটি করপোরেশনে মশক নিধনে লার্ভিসাইডিং, ফগিংসহ অভিযান ও প্রচারণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কারও অনুপস্থিতিতে কোনো কাজ থেমে নেই।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button