Bangladesh

মসনদ থেকে কাঠগড়ায়

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনে  ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২৩ আসনে জয়লাভ করে। ৫৬ জন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্রভাবে বিজয়ী হন। জাতীয় পার্টির বিদ্রোহীসহ ১০টি আসন পায় অন্যরা। ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পঞ্চমবারের মতো সরকারের যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী, ২৫ মন্ত্রী, ১১ প্রতিমন্ত্রী নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারাতে হয় টানা সাড়ে পনের বছর ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। শুধু ক্ষমতাচ্যুতই নয়, ক্ষমতার মসনদ থেকে কাঠগড়ায় এখন দলটির প্রতাপশালী নেতা-নেত্রীরা। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইশতেহারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। দেশি-বিদেশির কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখাতে অনেকটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় নির্বাচন। প্রায় প্রতিটি আসনে দলের ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে ৮৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। এদের ৫৬ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বাকিরা জাতীয় পার্টি, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ছিলেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কোথাও দুই ভাগ থেকে চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ডামি এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি ভেঙে দেওয়া হয়। এই দগদগে ক্ষত সইতে না সইতেই কয়েকটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলার ভোট শুরু করে আওয়ামী লীগ। নিজেদের হানাহানি কমাতে স্থানীয় নির্বাচন থেকে দলীয় প্রতীক তুলে দেয়। স্থানীয় সরকার ভোটে দলীয় প্রতীক ব্যবস্থার প্রবর্তক আওয়ামী লীগ হলেও সেটা এ বছর মানেনি। তারপরও ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। এমপিদের মাইম্যান, আত্মীয় লীগ, হাইব্রিড, দলের অনুপ্রবেশকারী ও টাকার কুমিরদের কাছে মাঠ ছেড়ে দেন ত্যাগী ও পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।

যখন একের পর এক ঘটনা প্রবাহে চাপে পড়ছে সরকার, এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেদিন থেকে চার দফা দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি দেয় সংগঠনটি। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায়। পরে সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নামে অবরোধ কর্মসূচি দেয়। এরপর থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন স্পটে তাদের কর্মসূচি ছিল। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি দেয়। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।’ এরপর ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন বাড়তে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় কারফিউ জারি করা হয়। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি কলঙ্কজনক অধ্যায় নিয়ে বিদায় নেয় শেখ হাসিনার সরকার। একটি বিশেষ বিমানে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশের বিভিন্ন থানায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকের নামে মামলা হয়। শেখ হাসিনার নামেই প্রায় ২ শতাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এদের অনেকেই এতই শক্তিশালী ছিলেন যে সারা দেশ থেকে আসা নেতা-কর্মী তো কোনো পাত্তাই পেতেন না, তাদের দাম্ভিকতা ছিল চরমে। দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে নব্যলীগারদের বেশি পছন্দ করতেন তারা। সরকার পতনের পর সেই দাম্ভিকতা দেখানো নেতারা কেউ পলাতক, কেউ জেলাখানায় বন্দি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button