মহাকর্ষ তরঙ্গের বাঁচামরার ইতিহাস
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ‘ইউএস ন্যাশনাল ফাউন্ডশন’-এর হল ঘরে বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকদের মিলনমেলা। বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। তখন ক্যালটেকের বিজ্ঞানী ডেভিড রিজ মঞ্চে এলন।
তারপর ভরাট গলায় ঘোষণা করলেন, আমরা মহাকর্ষ তরঙ্গে খোঁজ পেয়েছি।
পাক্কা এক শ বছর যে রহস্য বিজ্ঞানীদের নাকানি-চুবানি খাইয়েছে, সেই মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা দিয়েছেন বিজ্ঞানীদের পাতা জালে।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করে। সেই তত্ত্বেই ছিল মহকর্ষ তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী।
কিন্তু আইনস্টাই মহাকর্ষ তরঙ্গের ব্যাপারটা মানতে পারেননি।
১৯৩৬ সাল। আইনস্টাইন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্বেবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তখন তাঁর সহকর্মী ছিলেন রুশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী নাথান রোজেন।
দুজন মিলে অনেক হিসাব-নিকাশ করেলে। সিদ্ধান্তে এলেন, মহাকর্ষ তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণীটা ভুল ছিল।
রোজেন আর আইনস্টাইন মিলে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। সেটা পাঠালেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে। ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’য়ের একটা নিয়ম ছিল।
কোনো লেখা প্রবন্ধ এলে সেটা পাঠানো হত বিশেষজ্ঞদের কাছে। বিশেষজ্ঞরাও একেকজন মস্ত বিজ্ঞানী। তাদের বলা হতো রেফারি। রেফারিরা লেখার ভুলত্রুটি বের করতেন। সেগুলো উল্লেখ করে কোনো পরামর্শ থাকলে সেটাও লিখে দিতেন। পরামর্শসহ লেখাটা আবার পাঠানো হতো মূল লেখকের কাছে। রেফারির উল্লেখ করা পরামর্শ মেনে ভুলত্রুটি শুধরে দিলে তবেই লেখাটা প্রকাশ করা হত। তবে লেখককে জানানো হতো না আড়াল থেকে কে রেফারিগিরি করছেন। ব্যক্তিগত সংঘাত এড়ানোর জন্য।
আইনস্টাইন আর রোজেন যে প্রবন্ধটা রেফারির বিষয়টা মনঃপুত হলো না। তিনি বেশ কয়েককটি ভুল বের করলেন। তারপর কিছু পরামর্শসহ ফেরৎ পাঠালেন সম্পাদকের কাছে। সম্পাদক ভুলত্রুটি আর রেফারির পরামর্শসহ সেটা আবার ফেরৎ পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। জানতে চাইলেন, রেফারির পরামর্শ মেনে তাঁরা প্রবন্ধের ত্রুটি-বিচ্যূতি সংশোধন করতে রাজি আছেন কিনা।
এক কথা শুনে ভীষণ চটে গেলেন আইনস্টাইন। রেফারির পরামর্শ তাঁর পছন্দ হলো না। ফিজিক্যাল রিভিউয়ের সম্পাদককে টিঠি লিখে বলেন, ‘আমি লেখাটা আপনাকে পাঠিয়েছিলাম ছাপানোর জন্য, কোনো বিশেষজ্ঞকে পড়ানোর জন্য নয়। আপনার বিশেষজ্ঞের ভুল মন্তব্যের জবাব দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।’
আইনস্টাইন তখন অন্য একটা জার্নালে প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য পাঠান। এতে সাই ছিল রোজেনরও। সেই জার্নালটির নাম জার্নাল অব দ্যা ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট। জার্নালের সম্পাদক সেটা ছাপতে রাজি হন। সেটা গোছগাছ করে ফেরত পাঠান আইনস্টাইনের কাছে। প্রুফ কপিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়ার জন্য। ততদিনে প্রিন্সটন প্রিন্সটন ইনস্টিউটে যোগ দিয়েছেন পোলিশ বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড রবার্টসন। ওদিকে রোজেনের বদলে আইনস্টাইন পেয়েছেন নতুন সহযোগী। তাঁর নাম লিওপোল্ড ইনফেল্ড।
রবার্টসন একদিন তিনি ইনফেল্ডকে বলেই ফেললেন। আইনস্টাইন মহাকর্ষ তরঙ্গ বাতিল করতে চাইছেন, এ বিষয়টা তিনি মানতে পারছেন না। ইনফেল্ড আইনস্টাইনকে জানালেন সেকথা। এবার কিন্তু আইনস্টাইন চটলেন না। তিনি স্বীকার করলেন তাঁর আর রোজেনের লেখা প্রবন্ধে ভুল ছিল। সেটা তিনি গতরাতেই আবিষ্কার করেছেন। ভুলটা তিনি ধরেন ‘জার্নাল অব দ্য ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট’ থেকে পাঠানো প্রুফ কপিতে চোখ বোলাতে গিয়ে। অর্থাৎ ফিজিক্যাল রিভিউর রেফারি ধরা ত্রুটিগুলোই ঠিক। আইনস্টাইন ভুলগুলো শুধরালেন। ছাপা হলো সেটা।
মজার ব্যাপার হলো, ফিজিক্যাল রিভিউর যে রেফারি আইনস্টাইন আর রোজেনের ভুল ধরেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং হাওয়ার্ড রবার্টসন।
আইনস্টাইন তাঁর ভুল শুধরে নিলেন, তখন রোজেন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি এক সোভিয়েত পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলেন তাঁর আর আইনস্টাইনের প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে জার্নাল অব দ্য ফ্রাঙ্কলিন ইস্টিটিউট-এ।
সেদিন যদি আইনস্টাইন ভুলটা না শুধরাতেন, তাহলে এক শ বছর পর যে মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ল বিজ্ঞানীদের ডিটেক্টরে, সেটা কি পাওয়া যেত।