মহাকর্ষ তরঙ্গের সাতকাহন
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। বিজ্ঞান ইতিহাসের ‘রেড লেটার ডে’। বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা দিনটাকে তা-ই বলছেন। কেন বলছেন, তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ওই দিনটাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন। ‘ইউএস ন্যাশনাল ফাউন্ডশন’-এর হল ঘরে বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকদের মিলনমেলা। ঘোষিত হতে চলেছে এক অবিস্মরণীয় সাফল্যের খবর। পাক্কা একশ বছর যে রহস্য বিজ্ঞানীদের নাকানি-চুবানি খাইয়েছে আজ তার পরিসমাপ্তিতর দিন।
বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। হলঘরে পিনপতন নীরবতা। রুদ্ধদ্ধশ্বাস কোটিকোটি বিজ্ঞানপ্রেমী টেলিভিশন দর্শকদের মাঝেও।
অনেকটা নায়োকচিত ভঙ্গিতে মঞ্চে এলেন ক্যালটেকের বিজ্ঞানী ডেভিড রিজ।
মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর ভরাট গলায় ঘোষণা করলেন, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন! উই হ্যাভ ডিটেক্টেড গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ! উই ডিড ইট!’
উল্লসিত গোটা অডিটেরিয়াম, উল্লসিত গোটা বিশ্বের কোটি কোটি টিভি দর্শক।
কেনই বা একটা তরঙ্গকে নিয়ে এত উল্লাস? কী অমোঘ বস্তু সেই মহাকর্ষ তরঙ্গ?
মহাকর্ষ তরঙ্গ কী, জানতে হলে ফিরে যেতে হবে একশ বছর আগে। পদার্থবিজ্ঞান তখন দুটি চিরায়ত তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। একটা হলো নিউটনের গতিতত্ত্ব।
আরেকটা ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বও প্রকৃতিবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। তবে মহকর্ষ তত্ত্ব নিউটনের গতিতত্ত্বের বাইরে নয়।
তখনকার পদার্থবিজ্ঞান বেশকিছু সমস্যার ওপরে দাঁড়িয়ে। বিশেষ করে আলোর বেগের সমস্যা। নিউটন বলেছিলেন, আলো একধরনের কণা। এরপর ডেনিস বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসন রোমার আলোর গতি মাপতে সক্ষম হলেন। এর আগে আলোকে তাত্ড়্গণিক ব্যপার বলে মনে করতেন পণ্ডিতেরা। রোমারের এই আবিষ্কার নিউটনের কণাত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করল। যেহেতু আলোর নির্দিষ্ট গতি আছে তাই সে নিউটনের গতিসূত্রগুলো মানতে বাধ্য বলে ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। এখানেই হলো মস্ত ভুল।
নিউটনেরই সমসাময়িক বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস বললেন, আলো একপ্রকার তরঙ্গ। কারণ নিউটনের কণাতত্ত্ব দিয়ে আলোর ব্যাতিচার, অপবর্তনের মতো ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু আলোর তরঙ্গ চলে কীভাবে, কোন্ মাধ্যমের সাহায্যে? তখন বিজ্ঞানীরা কল্পনা করলেন এক অদৃশ্য মাধ্যমের। নাম তার ইথার। ধরে নেওয়া হলো শূন্য স্থানেও ইথারের অস্তিত্ব আছে। আর আলোর গতির হিসাব করা হতে লাগল ইথার নামের সেই স্থির মাধ্যমের সাপেক্ষে। তারমানে আলোর বেগ আপেক্ষিক। ধ্রুব নয়। কিন্তু সমস্যা একটা রয়েই গেল। আলো যদি ইথারের মধ্যে চলে সেই ইথার কী সব জায়গায়ই আছে? গোটা মহাবিশ্বই ইথারে নিমজ্জিত?
নিউটনের কণাতত্ত্ব আবিষ্কারের ঠিক দুশো বছর পর আলো নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনায় বসতে হলো বিজ্ঞানীদের। ১৮৬৫ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তার বিখ্যাত তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণগুলো প্রতিষ্ঠা করলেন। এই সমীকরণ অনুসারে আলো তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকেই বেরিয়ে এলো, চলার জন্য আলোক তরঙ্গের কোনও মাধ্যমের দরকার হয় না। গতিশীল চৌম্বকড়্গেত্র বিদ্যুত্ অবস্থার এবং গতিশীল বিদ্যুক্ষেত্র চৌম্বক অবস্থার জন্ম দেয়। মূলত এই ধারণা থেকেই ম্যক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বক তত্ত্বের জন্ম। আর এই তত্ত্ব থেকেই ইথারের ধারণার বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। কারণ এখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে আলোর বেগের নির্দিষ্ট মান।