Bangladesh

মহাসড়কের অবস্থা ভালো, ঈদে তবু ভোগান্তির ভয়

সড়ক-মহাসড়কের ৭৫ ভাগের অবস্থাই ভালো, তার পরও ঈদযাত্রায় ১৫৫ স্থানে যানজটের শঙ্কা রয়েছে। এবারের ঈদে মাঝে একদিন বাদে ১০ দিন ছুটি মিলতে পারে। ফলে ধাপে ধাপে যাত্রীরা যাবেন, এতে স্বস্তির হতে পারে ঈদযাত্রা। তবে ভয় জাগাচ্ছে সেতুর টোলপ্লাজার জট। এলেঙ্গা এবং গাজীপুরের সড়ক আগের বছরগুলোর মতো দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে। ঢাকা ছাড়তে হানিফ ফ্লাইওভারেও যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। 

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সদর কার্যালয়ে ঈদ প্রস্তুতি সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সভায় পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগ জানান কয়েকজন। এর জবাবে মন্ত্রী বলেছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুর্নীতি পৃথিবীর কোথায় হচ্ছে না? আমেরিকায়ও হচ্ছে। চাঁদাবাজি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, আজ প্রধানমন্ত্রীকেও এ নিয়ে বলতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির প্রভাব দ্রব্যমূল্যে পড়ে। 

গত বছরের ঈদুল ফিতরের ঈদযাত্রা স্বস্তির ছিল। সেবার টানা ৮ দিনের ছুটি ছিল। ফলে ধাপে ধাপে যাত্রীরা ঘরে ফেরায় মহাসড়কে খুব একটা চাপ ছিল না। কিন্তু ২৮ রমজানের রাত থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত যানজটে অচল ছিল ঢাকা-উত্তরবঙ্গ এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের অংশগুলো। যানজট ছিল যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতুতেও। 

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১১ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হবে। ৮ এপ্রিল থেকে ঈদের ছুটি শুরু। এর আগের দিন ৭ এপ্রিল শবেকদরের ছুটি। তার আগের দুই দিন শুক্র এবং শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ৮ এপ্রিল ছুটি নিলে ঈদের আগে ৬ দিন ছুটি মিলবে ধীরেসুস্থে ঘরে ফেরার। 

গত বছরের ঈদুল আজহায় ছুটি কম থাকায় তীব্র যানজট ছিল। একসঙ্গে সব যাত্রীর চাপ পড়লে মহাসড়কের সেতুগুলোতে কী অবস্থা হয়, সভায় এর পরিসংখ্যান দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরদির্শক মো. শাহাবুদ্দিন খান সমকালকে বলেন, সড়ক-মহাসড়ক প্রশস্ত এবং উন্নত হলেও গাড়ি সেতুতে আটকে যাচ্ছে। গাড়ি কতবার বন্ধ হয়, তার ধারণা পেতে যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতুর পরিসংখ্যান নেওয়া হয়।  গত বছর ঈদুল আজহার  আগের ৪ দিনে সেতুতে ৫৭ বার টোল আদায় বন্ধ হয়েছিল। ফলে সেতুতে গাড়ি প্রবেশ বন্ধ ছিল। এতে ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ১৬ মিনিট টোল আদায় বন্ধ ছিল, যা মোট সময়ে ১৮ শতাংশ। গাড়ির চাপের কারণে ২১ বার গাড়ি বন্ধ ছিল। এতে টোল আদায় বন্ধ থাকে ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট। সেতুর পূর্ব প্রান্তে রেললাইনের কারণে এলেঙ্গা প্রান্তে গাড়ি বাইপাস করা হয়। কিন্তু ট্রেন গেলে সেতুতে গাড়ি প্রবেশ বন্ধ রাখতে হয়। এতে ১৪ বারে ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট গাড়ি বন্ধ ছিল। সেতুতে ১০ দুর্ঘটনায় বন্ধ ছিল ৩ ঘণ্টা ১৪ মিনিট। ৮ বার গাড়ি বিকল হয়ে টোল আদায় বন্ধ ছিল ৩ ঘন্টা ৯ মিনিট। অন্যান্য কারণে ৪ বারে ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট টোল আদায় বন্ধ তথা সেতুতে গাড়ি প্রবেশ করেনি। বিকল ১৩ গাড়ির ১০টির কাগজপত্র ঠিক ছিল না এবং তিনটির ফিটনেস নেই। সুতরাং ফিটনেসবিহীন গাড়িই যানজটের মূল কারণ, এ ধারণা সঠিক নয়। 

সভায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর  জানায়, সারাদেশে ১৫৫টি স্থানকে তীব্র যানজটপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪৮, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে ৫২, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ৬, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৪১ এবং ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কের ৮ স্থানকে যানজটপূর্ণ বলা হয়েছে। গাড়ির ইউটার্ন, সড়কে বাজার, অবৈধ দখল, চলমান নির্মাণকাজ, বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা, বাস কাউন্টারকে যানজটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে ঈদের আগেপরে কয়েকদিন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন সেতুমন্ত্রী। 

ওবায়দুল কাদের বলেন, ঈদে কিছুটা যানজট হবে। একদম যানজটমুক্ত দাবি করা সমীচীন নয়। হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ এবং গাজীপুর ঠিক থাকলে, ঈদযাত্রার সব ঠিক থাকবে। হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ঢাকায় নির্বিঘ্নে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা না বাড়ালে যত আলোচনা করা হোক, সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, কিছুই কাজ হবে না বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, হাইওয়ে পুলিশ ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদার’। 

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম সভায় বলেন, এলেঙ্গায় দেড় কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ। এতে যানজট হতে পারে। চন্দ্রা এলাকায় গাড়ির তীব্র চাপ সৃষ্টি হয় ঈদের আগে। কলকারখানা ধাপে ধাপে ছুটি হলে চাপ কমানো সম্ভব। 

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, বিভিন্ন জেলার লোকাল বাস যাত্রী পেতে ঈদে ঢাকায় চলে আসে। এসব লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি বিকল হয়ে যানজট হয়। এসব গাড়ির ঢাকায় প্রবেশ ঠেকাতে হবে। 

চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, চাঁদা আর চাঁদাবাজি এক নয়। চাঁদাবাজি বন্ধ করা পুলিশের কাজ। 

এর জবাবে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, সড়কে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলা যাবে না।

বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, উত্তরবঙ্গের হাটিরকুমরুলে কয়েক বছর ধরেই নির্মাণকাজ চলছে। এতে এবারও যানজট হতে পারে। 

পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশ ঠিক থাকলে, সব ঠিক থাকবে। 

সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, মহাসড়কে তিন চাকার যান, মোটরসাইকেল ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো– সব মিলিয়ে দুর্ঘটনা হয়। সড়কে সবচেয়ে বড় উপদ্রব তিন চাকার গাড়ি ও মোটরসাইকেল। হাইওয়ে পুলিশকে ২২ জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন বন্ধ করতে হবে। 

ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই সেক্টরের মন্ত্রী। প্রতিবছর ঈদযাত্রার সভা হয়। তবে সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা ঠিকভাবে পালন হচ্ছে কিনা, তা আর পরে মূল্যায়ন করা হয় না। ঢাকার যানজট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফেনী থেকে হানিফ ফ্লাইওভারে আসতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে বেশি সময় লাগে ফ্লাইওভার থেকে ঢাকায় ঢুকতে। এখন মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে, দুই ঘণ্টা লাগে। ঈদযাত্রায় যাত্রাবাড়ীর যানজট, উত্তরবঙ্গের মহাসড়কের কাজ, গাজীপুরে বিভিন্ন মহাসড়ক, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাশের যানজট, এলেঙ্গার যানজট নিরসনে দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। 

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, হানিফ ফ্লাইওভারে প্রচণ্ড যানজট হয় টোলপ্লাজার কারণে। ঈদের আগে ও পরে কিছুদিন এখানে টোল বন্ধ রাখা উচিত। এর ভর্তুকি সরকার দেবে। 

প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদের আগে ও পরে তিন দিন করে মহাসড়কে পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রাখা, ঈদের সাত দিন আগে থেকে সিএনজি স্টেশন এবং পেট্রোল পাম্প ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, ঈদের সাত দিন আগে মেরামতকাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয় সভায়। এ ছাড়া কলকারখানা ধাপে ধাপে ছুটি দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী, সেতু সচিব মনজুর হোসেন, বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুরু মোহাম্মদ মজুমদারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পরিবহন নেতারা। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button