Trending

মাছ ধরায় যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ কৃষি রাসায়নিক পদার্থ

মানুষের স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও, এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো কৃষি সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে সহজেই পাওয়া যায়।

অষ্টগ্রাম, মিঠামইন এবং ইটনাকে যুক্ত করা কিশোরগঞ্জের হাওরের বুক চিরে যাওয়া বিশাল রাস্তা। তার পাশেই বিস্তৃত জলাভূমির ওপর দিয়ে চিল উড়ছিল। এটি সম্প্রতি সরে যাওয়া বিশাল পানির অবশিষ্ট অংশ মাত্র। মাঝে মাঝে চিলগুলো পানিতে ঝাঁপি দিচ্ছিল এবং ছোঁ মেরে কিছু একটি তুলে নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল।

আমরা প্রথমে ধারণা করলাম চিলগুলো হয়ত মাছ ধরছে। কিন্তু বিষয়টি শুরুতে অস্বাভাবিক মনে হলো। আমরা ভাবলাম, হঠাৎ কেন এতা মাছ পানির ওপর ভেসে উঠলো? তাই কৌতূহল থেকে আমরা আরও কাছ থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করলাম। আমরা যা দেখলাম, তা ছিল উদ্বেগজনক। ছোট ছোট মাছ সত্যিই পানিতে মৃত অবস্থায় ভেসে ছিল।

দৃশ্যটি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো যখন পানির ওপর দেখলাম মৃত ব্যাঙ ও কাঁকড়াও ভেসে উঠছে। এমন সময় হঠাৎই একটি মহিষ ছুটে গিয়ে পানিতে নেমে গেল। কিন্তু আতঙ্কিত রাখাল সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে মহিষটিকে পানি থেকে টেনে তুলে আনল। 

বিষয়টি সম্পর্কে রাখালকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন, তিনদিন আগে কিছু জেলে ওই পানিতে কিছু ওষুধ দিয়েছে। এর ফলে পানি এত বিষাক্ত হয়ে গেছে যে তা প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর।

এগুলো কী ধরনের ‘ওষুধ’ যা প্রাণ বাঁচানোর বদলে প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়? এগুলো আসলে কীটনাশকের মতো রাসায়নিক পদার্থ যাকে স্থানীয়রা ‘ওষুধ’ বলে থাকেন। এগুলো আসলে বিষ। জেলেরা সহজে মাছ ধরার জন্য এ রাসায়নিক পদার্থগুলো ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষাক্ত পদার্থগুলো পানিতে মেশালে মাছগুলো মারা যায় এবং ভেসে ওঠে, যা জেলেদের মাছ ধরার কাজকে খুব দ্রুত ও সহজ করে দেয়। 

এই বিষ দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি একসময় সুন্দরবনের খালগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর আগেও একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, পদ্মা নদীতেও বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ ধরার পদ্ধতিটি ব্যাপক হারে প্রচলিত।

মানুষের স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও, এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো কৃষি সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে সহজেই পাওয়া যায়। সরবরাহকারীরা দাবি করেন, কৃষির জন্য অপরিহার্য হওয়ায় এগুলোর অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের মৎস্য সংরক্ষণ আইন পানিতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে, তবে এই ধরনের রাসায়নিকের আমদানি ও অপব্যবহার ঠেকাতে দেশের নীতিমালা কার্যকর হয়নি। এসব রাসায়নিকের মধ্যে ল্যাম্বডা-সাইহ্যালোথ্রিন এবং গ্লাইফোসেটের মতো উপাদান রয়েছে (নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড নাম উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি), যা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ ও অঞ্চলে নিষিদ্ধ।

কৃষি বিষয়ক কর্মকর্তা এবং সরবরাহকারীরা জানান, এখন বাজারে পরিবেশবান্ধব বায়োপেস্টিসাইড পাওয়া যাচ্ছে, যা নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি। তবে প্রচলিত রাসায়নিকের অপব্যবহার এতটাই ব্যাপক যে, এই নতুন বিকল্পের ব্যবহার এখনও সীমিত।

অপব্যবহার ঠেকানো অসম্ভব

স্থানীয় কৃষি রাসায়নিক বিক্রেতা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা সবাই একমত যে, কৃষকদের ফসল উৎপাদনের জন্য আগাছানাশক ও কীটনাশক প্রয়োজন। ফলে এগুলোর ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা সম্ভব নয়।

বান্দরবানের এক স্থানীয় বিক্রেতা মিন্টু বলেন, “আমরা জানি না ক্রেতা ঠিক কী কাজে এই রাসায়নিক ব্যবহার করবেন। তিনি স্বীকার করেন, মাছ ধরার জন্য এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) এক কর্মকর্তাও মিন্টুর সাথে একমত পোষণ করেন। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, “মানুষ আত্মহত্যার জন্য কীটনাশক খেয়ে থাকে। আমরা কি সেই কারণে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে পারি?”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) যদি প্রয়োজন মনে করে, মৎস্য চাষে ওপর এসব কিটনাশকের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য নতুন আমদানি করা বা কৃষি রাসায়নিকগুলোর নমুনা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) পাঠাবে।

বিএফআরআই-এর মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, পাঠানো রাসায়নিকের নমুনা দুই থেকে চারগুণ বেশি পরিমাণে ডোজ দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয় এবং এর ভিত্তিতে ল্যাব রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। 

তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “এসব পরীক্ষা শুধু বৃষ্টির পর পানিতে রাসায়নিকের প্রভাব কতটুকু তা বিশ্লেষণ করার জন্য চালানো হয়- এর বাইরে কিছু নয়।” তিনি আরও জানান, অনুমোদিত পণ্যও যদি অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হয়, তবে তা মাছ মেরে ফেলতে পারে।

অনেক দেশেই নিষিদ্ধ এসব রাসায়নিক পদার্থ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (আএআরসি) গ্লাইফোসেটকে সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

২০২০ সালে জার্মান রাসায়নিক কোম্পানি বায়ারকে গ্লাইফোসেটভিত্তিক আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে ক্যান্সারের অভিযোগে দায়ের হওয়া হাজার হাজার মামলা মীমাংসা করতে প্রায় ১০.৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য শস্যে গ্লাইফোসেট ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত।”

প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ১০টি দেশে, যেমন জার্মানি, সৌদি আরব এবং ভিয়েতনামে গ্লাইফোসেট নিষিদ্ধ বা নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া আরও অন্তত ১৫টি দেশ গ্লাইফোসেটের ব্যবহার সীমিত করেছে।

ডিএই-এর একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে গ্লাইফোসেট ধীরে ধীরে ২০২৬ সালের মধ্যে বন্ধ করা হবে। তবে ল্যাম্বডা-সাইহ্যালোথ্রিন নিষিদ্ধ বা এর ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি।

এদিকে, ২০২০ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ল্যাম্বডা-সাইহ্যালোথ্রিন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশে এই রাসায়নিকের নির্দিষ্ট ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

জৈব আগাছানাশক ও কীটনাশক

বান্দরবানে মিন্টুর দোকানে কিছু জৈবভিত্তিক কীটনাশক দেখা পাওয়া গেল। বিক্রেতারা জানান, এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং নির্দিষ্ট পোকামাকড়কে লক্ষ্য করে কাজ করে, উপকারী পোকাগুলোকে ক্ষতি করে না। রাসেল আইপিএম বাংলাদেশ এবং এসিআই এই ধরনের কীটনাশক বাজারজাত করছে।

মিন্টু বলেন, জৈব কীটনাশক বাজারে তুলনামূলক নতুন। তবে যারা সাধারণত কৃষকদের তথ্য ও পরামর্শ দেন সেই স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

কৃষিবিদ রাকিবুল হাসান জানান, জৈব কীটনাশক এবং ফেরোমোন ফাঁদ কেবল ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনেই কার্যকর। ডিএই কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন যে জৈব কীটনাশক এবং জৈব আগাছানাশক মাছের ক্ষতি করতে পারে না।

তাহলে বিষাক্ত কৃষি রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক কেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না? 

এ বিষয়ে রাকিব বলেন, সমন্বিত পোকা ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) পদ্ধতি উভয় ধরনের কীটনাশক নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। তিনি শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে বলেন, হঠাৎ করে রাসায়নিক কীটনাশক বন্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ডিএই-এর এক কর্মকর্তা রাকিবের কথার সাথে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে, কৃষকদের জৈব কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, নতুন জৈব আগাছানাশক ও কীটনাশক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সংবাদমাধ্যমে জানান, তার মন্ত্রণালয় শিগগিরই বিষ দিয়ে মাছ ধরা রোধে কাজ শুরু করবে। তবে তার সাথে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button