মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় আসতে পারে ডিসেম্বরের মধ্যে

কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে দেশ জুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়। জনরোষে ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুলাই আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন বিচারের মুখোমুখি শেখ হাসিনা। শুধু তিনিই নন, তার সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক অনেক আমলাও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি। ইতিমধ্যে বিচারপ্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনার মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আরও তিনটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলতি মাসে শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। দশটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার রায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রসিকিউশন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর সঙ্গে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিঘ্নে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্দোলনরতদের অবস্থান চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হয় ড্রোন। গুলি ছোড়া হয় হেলিকপ্টার থেকে। এতে প্রাণ হারায় বাসা-বাড়িতে অবস্থান করা অনেক শিশু।
৩৬ দিনের এই আন্দোলনে দেড় হাজারের মতো ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের মতো মানুষকে গুরুতর জখম করা হয়। চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে।
এসব নিহত-আহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে ৪৫০টি অভিযোগ দাখিল করেন ভিকটিম ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এসব অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালে ৩০টি বিবিধ মামলা দায়ের করে প্রসিকিউশন। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাবেক অনেক মন্ত্রী ও এমপিদের। আসামির তালিকায় আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ে থেকে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি করেছেন এমন পুলিশ সদস্যরা। এসব মামলায় ২০৯ জন আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন ৮৪ জন। পলাতক রয়েছেন ১২৫ জন। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। আশ্রয় নেন ভারতে। পলাতক অবস্থায় তার বিচার চলছে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করেও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানো যায়নি। এদিকে পলাতক থেকে ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে বিচারকাজকে বাধাগ্রস্তের অভিযোগে আদালত অবমাননার মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠিত একটি ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত বিবিধ দুটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গত ১৭ অক্টোবর প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর একে একে বেশ কয়েকটি বিবিধ মামলায় পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। পরে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। তদন্তাধীন মামলার মধ্যে চারটি মামলার তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দুটি এবং ট্রাইব্যুনাল-২-এ আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানো এবং রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিচার চলছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছে। হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। বিচারপতি মো. গোলাম মুর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মামলার পাশাপাশি বিচার চলছে রাজধানীর চাঁনখারপুলে ছয় জনকে গুলি করে হত্যার মামলার।
এই চার মামলা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
এছাড়া যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও দশটি মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছি। শহিদদের পরিবার, ভুক্তভোগী ও স্বজনদের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান, আইন ও আসামিদের অধিকার মেনেই বিচার চলছে। এর জন্য যে সময় প্রয়োজন, আমরা সেটুকু নিচ্ছি। তবে এর মানে এই নয় যে, বছরের পর বছর সময় লাগবে। বিচারপ্রক্রিয়া যেভাবে এগোচ্ছে, টপ কমান্ডারদের অন্তত একটি বড় অংশের বিচার ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে—এই আশ্বাস দিতে পারি।’
দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে মামলা : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর সারা দেশে দায়ের করা ১ হাজার ৬০১টি মামলা। যার মধ্যে ১২টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলা। বেশির ভাগ মামলা হয়েছে গত বছরের ১৯ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্টের হতাহতের ঘটনায়। ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে।