Hot

মানবিক করিডরের নামে কী হচ্ছে! জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা

জাতিসংঘের অনুরোধে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়া নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এমন করিডর দেওয়ার পক্ষে কোনো জুতসই যুক্তি দেখছেন না। বরং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মিয়ানমার কিংবা আরাকান আর্মি কেউই মানবিক সাহায্য চায়নি। রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা জাতিসংঘের তরফে বলা হলেও মিয়ানমার এমন কোনো আশঙ্কা করছে না। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশে দেশে করিডর দেওয়া হলেও সেগুলোর পরিণতি ভয়াবহ হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার করিডর নিয়ে কী হচ্ছে তা খোলাসা করছে না।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, সরকার মানবিক করিডর দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। বিএনপি বলছে, এমন করিডর বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে। অহেতুক বাংলাদেশ কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা স্পষ্ট নয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরকালে মানবিক করিডর দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তবে দেশের অভ্যন্তরে তীব্র সমালোচনার মুখে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, করিডর নয়, বাংলাদেশ আসলে প্যাসেস দিচ্ছে।

তার ভাষায়, করিডর ও প্যাসেসের মধ্যে বিস্তর তফাত। যদিও কী তফাত সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই বলেননি তিনি। ফলে একটা ধূম্রজাল চারপাশে ঘিরে আছে। কী হচ্ছে মানবিক করিডর নিয়ে! কেন এই লুকোচুরি! রোহিঙ্গাবিরোধী কট্টর বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মিকে মানবিক সহায়তা দিলেও তা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কোনো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। বরং নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ মানবিক করিডর বানিয়েছিল। তার ফলে সেখানে এখন ন্যাটোর স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। ইরাকে নো ফ্লাই জোনের নামে করা হয়েছিল মানবিক করিডর। এখন দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি হয়েছে।

২০১১ সালে মানবিক সহায়তা এবং নাগরিক সুরক্ষার নামে ন্যাটো ও জাতিসংঘ লিবিয়ার বেনগাজিতে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পথ তৈরি করে এবং দেশটিকে টুকরো টুকরো করে দেয়। সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব ও রাকা অঞ্চলে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার নামে যে পশ্চিমাদের অভ্যন্তরীণ করিডর তৈরি করা হয়েছিল তার ফলে সিরিয়ায় এক যুগের বেশি সময় গৃহযুদ্ধ হয়েছে। আফগানিস্তানের শুরুটা হয়েছিল করিডর দিয়ে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের যে সার্বভৌম সীমান্ত আছে, সেটাকে আমরা স্বীকার করি। সীমান্ত পার হয়ে তাদের দেশে কোনো কিছু পাঠাতে চাইলে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সম্মতি লাগবে। এই ধরনের সম্মতি পাওয়া গেছে বলে আমরা জানতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে বর্তমানে যে গৃহযুদ্ধ চলছে। রাখাইন খুবই জটিল সংঘাতপূর্ণ এলাকা। করিডর স্থাপন করে সেখানে সাহায্য দিতে যাই, তাহলে একটা সংঘাতপূর্ণ এলাকার সঙ্গে আমরা নিজেদের জড়িত করব। আর পরিস্থিতিটা যেহেতু খুবই জটিল, ফলে আমরা কেন এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলব? এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সাধারণত আন্তর্জাতিকভাবে যেটা দেখা যায়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যদি কোনো সংঘাতময় এলাকা থাকে তাহলে তার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। তার সঙ্গে কেউ যুক্ত হয় না। এক্ষেত্রে আমরা কি স্বার্থে সেখানে নিজেদের জড়িত করতে যাচ্ছি, এ ব্যাপারে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে পাইনি।

এম মুনীরুজ্জামান বলেন, করিডর তো মুখে মুখে হয় না। করিডর হতে গেলে একটা স্থাপনার জন্য ভৌগোলিক রূপরেখা এবং এর নিরাপত্তা কী হবে? নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে-এ ব্যাপারেও আমাদের পরিষ্কার কিছু বলা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আরেকটা ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা খুবই স্পর্শকাতর এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত একটি সিদ্ধান্ত। এই বড় ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এককভাবে নেওয়া উচিত হবে না। সাধারণত এই বিষয়ে সংসদে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের এখানে বর্তমানে কোনো সংসদ নেই। ফলে সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিশদভাবে আলাপ-আলোচনা করে তাদের সম্মতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, মার্চে মানবিক করিডরের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল কারণ সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছিল। তিনি বলেন, করিডরের প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজি হলে আপাতত যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সেটা কমতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা সহায়তা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের বিষয়টি আরাকান আর্মিও ইতিবাচকভাবে দেখবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যেসব অঞ্চলে যুদ্ধ চলে, সেখানে মানবিক করিডর বা সহায়তা খুবই স্পর্শকাতর। কারণ এর সঙ্গে সামরিক বিষয় চলে আসে। কুর্দিস্তান, বসনিয়া ও ইউক্রেনে মানবিক করিডর নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মধ্যেও সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণ ও যুদ্ধ পরিস্থিতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব বিবেচনা করে মানবিক করিডরের জন্য বাংলাদেশের বিকল্পগুলোও পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।

জানতে চাইলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক আবু রূশ্দ যুগান্তরকে বলেন, এটা মানবিক করিডর। রাখাইন এখন আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সৈন্যরা পরাজিত হয়ে চলে গেছে। সেখানে খাবার, চিকিৎসাসামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের পোর্টগুলো কাজ করছে না। মিয়ানমার আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে সেগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে জাতিসংঘ অনেকগুলো দেশের অনুরোধে এটা বলেছে।

কিন্তু আমাদের দেশে কী কারণে জানি না এটা নিয়ে আমেরিকা বা পশ্চিমাদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ওরা এখান থেকে ভূমি নেবে। আসলে এখান থেকে ভূমি নেওয়ার বিষয় নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে জাতিসংঘ খাদ্য-চিকিৎসাসামগ্রী আমাদের এখানে চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে দেবে। তারপর ওরা করিডর করে এটা রাখাইনে নিয়ে যাবে। এটা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে জানাতে হবে এবং তাদের অনুমতি সাপেক্ষে এটা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল সব রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নেওয়া। আমাদের সিকিউরিটি ইস্যুগুলো কী দাঁড়াতে পারে। কী সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু আসলে এটা নিয়ে রাখঢাক করা হয়েছে। হুট করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আমরা করিডর দিতে যাচ্ছি। এতে জনগণের মধ্যে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, করিডর মানে হচ্ছে কেউ আমাদের ভূমি নিয়ে যাচ্ছে। আসলে ওটা এ রকম নয়।

আবু রূশ্দ বলেন, এখন এই বিষয়টা খোলাসা করতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে। একটা ট্রান্সপারেন্সি রাখা উচিত ছিল, যেহেতু এটা জাতিসংঘের অনুরোধ। এটা সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও উপদেষ্টার দায়িত্ব। কিন্তু তারা এখনো ঠিক সেভাবে করছেন না। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য আসতে দেখা যাচ্ছে। সংশয়টা ঘনীভূত হচ্ছে। মিয়ানমার, চীন এবং আসিয়ান দেশগুলোর রাজি হওয়ার পর আমরা যদি কখনো জাতিসংঘের প্রস্তাবে রাজি হই তখনো আমাদের নিজেদের স্বার্থ দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto