International

মানবিক বিপর্যয়ের মুখে গাজা

দখলদার ইসরাইলের ‘পোড়ামাটি’ নীতি ঘোষণা উপত্যাকাজুড়ে বাতাসে ফসফরাসের গন্ধ : জাতিসংঘ স্কুল ও দুটি উদ্বাস্তু শিবিরে হামলা : নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই সমাপ্ত : যুদ্ধবন্দি ইসরাইলের জেনারেলসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস : ৮শ’র বেশি ইসরাইলি এবং ৪শ’ ফিলিস্তিনিসহ নিহতের সংখ্যা ১২শ’ ছাড়িয়েছে : পৃথিবীর প্রভাবশালী দেশগুলো দুই ধারায় বিভক্ত : বিশ্বের দেশে দেশে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং দখলদার ইসরাইলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

সত্তর বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো বড় ধরনের বেকায়দায় পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। যুগের পর যুগ গণহত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বসতি থেকে উচ্ছেদে অতিষ্ঠ স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত শনিবার মুহুর্মুহু রকেট হামা চালিয়ে শুধ ইসরাইলিদের হত্যাই করেনি, বরং যাদের নেতৃত্বে অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে সেইসব সামরিক কর্মকর্তাদেরও যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করেছে। প্রাথমিকভাবে হতাহতের সংখ্যা আঁচ করতে না পারলেও পরে ভয়াবহতা টের পেয়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ শুরু করেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ-ে ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপের নির্দেশ দিয়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ পরিষেবা এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ঘোষণাটি আসে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালেন্টের পক্ষ থেকে। তিনি বলেছেন, হামাস অধিকৃত গাজায় অবরোধের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। খাদ্যও ঢুকতে দেয়া হবে না। ‘নৃশংস’ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়। ২০০৭ সাল থেকে উপত্যকাটিতে স্থল ও জলপথে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে ইসরাইলি সরকার। ফলে আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে চলতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।

ইসরাইলের এমন ঘোষণায় পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে যাবে গাজা উপত্যকা। ইসরাইল ও হামাসের তীব্র লড়াইয়ে চরম উত্তেজনা ছড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলটিতে। দু’পক্ষেরই ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও ফিলিস্তিনিদের ওপর দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের জেরে এ হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। গাজা ভূখ-ের যে অংশটুকু এখন পর্যন্ত টিকে আছে, ইসরাইলের হাত থেকে এরাই রক্ষা করে আসছে। এ পরিস্থিতিতেও বেসামরিক স্থাপনাকে টার্গেট করে যাচ্ছে ইসরাইলি বিমান।

ইসরাইলে হামাসের হামলা ও গাজায় দখলদারদের বিমান হামলায় নিহতের সংখ্যা ১২শ’ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইলি নিহত হয়েছে ৭শ’রও বেশি এবং ফিলিস্তিনি শহীদদের সংখ্যা ৫শ’ ছুঁইছুঁই করছে।
গত রোববার রাতভর অবরুদ্ধ গাজায় বিমান হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজার শতাধিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলার প্রভাবে গাজার ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। গতকাল এমনটাই জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত রোববার রাতে গাজায় ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক হামলায় ফিলিস্তিনের ১৫৯টি বেসামরিক ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। আরো ১২শ’র বেশি আবাসিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফিলিস্তিনি শরণার্থীর জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ২২৫ জনের বেশি লোকজন আশ্রয় নেওয়া একটি স্কুলে সরাসরি হামলা চালায় ইসরাইল। এমন বাস্তবতায় অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা উপত্যকা। চারদিকে সাধারণ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সব কিছু হারিয়ে পথে বসে পড়েছে অনেকে। যে যেভাবে পারছে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আহতদের চাপ বাড়তে থাকায় হিমিশিম খাচ্ছেন স্বাস্থকর্মীরা। মানবিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এহেন পরিস্থিতিতেও বেসামরিক স্থাপনাকে টার্গেট করে যাচ্ছে ইসরাইলি বিমান।

খবরে বলা হয়, রাতভর হামলা চালিয়ে ইসরাইলি সেনারা তছনছ করে ফেলেছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। হামলার জেরে সোমবার পর্যন্ত উপত্যকার ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা দফতর ওসিএইচএ এ তথ্য জানিয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা অনলাইন জানিয়েছে, গাজার প্রতিবেশী এলাকা ইয়ারমুকে রাতভর হামলা চালিয়ে চারটি মসজিদ ধ্বংস করেছে ইসরাইলি সেনারা। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হামলায় ৪৯৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২ হাজার ৭৫০ জন আহত হয়েছে। কয়েক ডজন ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বাসিন্দারা সাদা ফসফরাসের গন্ধের কথা জানিয়েছেন। আগে গাজায় ইসরাইলি বাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ এই রাসায়নিক ব্যবহার করতো।

ইসরাইল জানিয়েছে, তারা গাজা উপত্যকায় পাঁচ শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। দক্ষিণ ইসরাইলের বেশ কয়েকটি এলাকায় হামাস যোদ্ধাদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। গাজার বাসিন্দা রেফাত আল আরির আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘পুরো ব্লকে ইসরাইলি বোমাবর্ষণ, ঘুমন্ত ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা, মসজিদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে হামলার বর্ণনা দেওয়ার মতো বিশেষণ আমাদের কাছে শেষ হয়ে গেছে।…আমি মনে করি এটি কেবল শুরু, কারণ বোমাবর্ষণ ১০ ঘণ্টায় এক মিনিটের জন্যও থামেনি।’

অপর এক খবরে বলা হয়, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে, তখন রুদ্ধদ্বার জরুরি অধিবেশন শেষ করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু এ ইস্যুতে তারা একটি যৌথ বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল-জাজিরা বলেছে, হামাসের কয়েক হাজার রকেট হামলা থেকে শুরু করে যুদ্ধে কমপক্ষে ১৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। ইসরাইল একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করে ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় অবিরাম বোমা হামলা চালাচ্ছে। এমন অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি অধিবেশনে বসে। সেখানে পরিষদের ১৫ সদস্যের প্রতি হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানানোর আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। অধিবেশনের পর সাংবাদিকদের কাছে মার্কিন সিনিয়র কূটনীতিক রবার্ট উড বলেন, হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছে বেশ কিছু দেশ। তবে স্পষ্টতই সবাই নিন্দা জানায়নি। তাদের সম্পর্কে আমি কিছু না বললেও সম্ভবত আপনারা তাদের একটি দেশকে চিনতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি রাশিয়ার দিকে ইঙ্গিত করেন। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে খারাপ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চলে প্রায় ৯০ মিনিট বা দেড় ঘণ্টা। এতে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শান্তির দূত টোর ওয়েন্সল্যান্ডের ব্রিফিংয়ের ওপর শুনানি হয়।

কূটনীতিকরা বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর চেয়ে রাশিয়ার সদস্যরা তাদের দেশের ওপর ব্যাপক নজর দেয়া হবে বলে আশা করছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো প্রস্তাবে যৌথ বিবৃতির জন্য প্রয়োজন সর্বসম্মত মত। জাতিসংঘে রাশিয়ার দূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া পরিষদে বলেছেন, আমার বার্তা হলো অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। অস্ত্রবিরতি করতে হবে। অর্থপূর্ণ সংলাপ হতে হবে। দশকের পর দশক ধরে এ কথাটিই বলা হয়েছে। অনিষ্পন্ন এসব ইস্যুর আংশিক ফল এই যুদ্ধ।

২০০২ সালে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা বলেছে, এ সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরো বৈঠক প্রয়োজন। দেশটির রাষ্ট্রদূত লানা জাকি নুসেইবে বলেন, আমি মনে করি প্রত্যেকেই বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি ভয়াবহ উদ্বেগের। নিরাপত্তা পরিষদের অনেক সদস্যই বিশ্বাস করেন এ সংকটের ফাইনাল সমাধান হলো দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। তবে এই মিটিংয়ে যোগ দেননি ইসরাইল বা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কেউ। তবে ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের জন্য কূটনীতিকদের দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মানসুর। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলো যখন ইসরাইলিরা মারা যান, তখন কিছু মিডিয়া এবং রাজনীতিক কথা বলা শুরু করেন। তিনি আরো বলেন, এটা সেই সময় নয় যখন ইসরাইলকে তার ভয়াবহতা দ্বিগুণ করতে অনুমতি দেয়া যায়। এটা সেই সময়, যখন ইসরাইলকে তার পথ পরিবর্তনের জন্য বলা উচিত। তাদেরকে বলা উচিত শান্তির একটি পথ আছে। তাতে কোনো ফিলিস্তিনি বা ইসরাইলি নিহত হবেন না।

এদিকে সংগীত উৎসব ও অন্যান্য স্থান থেকে ইসরাইলিদের বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, ১০০ সেনা ও সাধারণ মানুষ অপহরণ করা হয়েছে। বেরি শহরের একটি ফুটেজে দেখা গেছে, চারজন সাধারণ মানুষকে হামাস যোদ্ধারা জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছে বিবিসি। এছাড়া, অনলাইনে আরো অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে দেখা গেছে,গাজার ব্যস্ত সড়ক দিয়ে ইসরাইলিদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইসরাইলিদের বন্দি করার পাশাপাশি জিকিম ও রিমে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে হামাস।

রিম শহরের কাছের একট সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ভিডিওতে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া বেশ কিছু গাড়ি সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গোলাগুলিতে কতজন আহত হয়েছে সেটি অবশ্য জানা যায়নি।
হামাসের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চ্যানেল থেকে একের পর এক ইসরাইলি সেনার মরদেহের ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে ছবিগুলো আসল কি না, সেটি যাচাই করে দেখতে পারেনি বিবিসি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার রকেট হামলায় শত শত ইসরাইলি নিহত হয়েছে। কেউ ভাবতেই পারেনি যে, এমন হতে পারে। প্রাণঘাতী ও দ্রুত এ হামলার ইসরাইলকে হতবাক করেছে। এর কয়েকে ঘণ্টা পরেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি’।

ইসরাইলি হামলায় চার জিম্মি নিহত : হামাস
গাজা উপত্যকায় রাতভর ইসরাইলের বিমান হামলায় গতকাল সকালে চার যুদ্ধবন্দি নিহত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। তাদেরকে আটক করে রেখেছিল ফিলিস্তিতিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ওই গোষ্ঠীর এক মুখপাত্র ওই চার জিম্মি নিহতের কথা জানিয়েছে। হামাসের ইসরাইল থেকে কতোজনকে অপহৃত করে বন্দী করে রেখেছে, সেটার সঠিক কোন সংখ্যা এখনও জানা যায়নি, তবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গতকাল সকালে বলেছে এই সংখ্যা কম নয়।

তবে হামাস যুদ্ধবন্দি শীর্ষ সামরিক অফিসারদের ভিডিও প্রকাশ করেছে। ইসরাইলের যেসব শীর্ষ সামরিক অফিসারদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন, সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিলের সদস্য জেনারেল আকিন ওজতুর্ক, জেনারেল ইলহান সালুর, জেন্ডামেরিন স্কুল কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদিক কোরোগলু, নেভাল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল মুরাত সিরজাই, নেভাল ফোর্সেস ট্রেনিং ডিভিশনাল চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল ইহসান বাকার, জেনারেল স্টাফ ইন্টেলিজেন্স চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফা ওজসয়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওগুজ শাহিন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তিমুরসান ইরমিজ, রিয়ার অ্যাডমিরাল হাসান কুলাক, রিয়ার অ্যাডমিরাল ওগুজ কাহরামান।

শনিবার সকাল বেলায় বেশিরভাগ ইসরাইলি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। দিনটি ইহুদিদের পবিত্র উৎসবের দিন সাব্বাত ছিল। এই দিনে ইসরাইলিরা বাড়িতে বসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কেউ কেউ সিনাগগ কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আড্ডা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক রকেটের হামলার মুখোমুখি হন তারা। যা ছিল একপ্রকার নজিরবিহীন হামলা। অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিনের শহর গাজা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল ইসরাইল। কিন্তু গত শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। হামাস গাজা থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হামলা কীভাবে চালিয়েছে, তা জানতে স্থানীয় লোকজন ও সশস্ত্র যোদ্ধাদের করা ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রকেট আসতে শুরু করে।

ইসলামী সশস্ত্র সংগঠনটির (হামাস) হাতে গাজার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যারা যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তারা মাঝেমধ্যেই রকেট ছুড়ে ইসরাইলে হামলা চালায়। প্রথম প্রথম হামাসের ছোড়া রকেট ইসরাইলের উন্নত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু গত শনিবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে হামাসের ছোড়া হাজার হাজার রকেট তা প্রতিহত করতে পারেনি। হামলার ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করে অস্ত্র মজুত রাখা হয়েছিল। হামাস বলছে, প্রথম দফার তারা অন্তত ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। তবে ইসরাইলের দাবি, এই সংখ্যা অর্ধেক। গাজা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুজালেমে রকেট ছোড়া হয়েছিল। এ সময় সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক করা হয়। হামলার পর ইসরাইলের বিভিন্ন শহর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। রকেট ছোড়ার পাশাপাশি গাজা সীমান্তে শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ইসরাইলে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা।

২০০৫ সালে গাজা থেকে সেটেলার ও সেনাদের প্রত্যাহার করেছিল ইসরাইল। কিন্তু তারপরেও সেখানকার আকাশ, সমুদ্র ও সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের হাতেই রয়েছে। এছাড়া গাজা সীমান্তে ইসরাইলি সেনারা নিয়মিত টহল দেয়। সীমান্তের কোথাও কোথাও কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও আবার বেড়া রয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ক্যামেরা ও সেন্সরও স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। কিন্তু সব কিছু ফাঁকি দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দফায় দফায় এসব সুরক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা হয়।

হামাস কীভাবে ইসরাইলে ঢুকে পড়ল?
কিছু কিছু হামাস যোদ্ধা বিকল্প উপায়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। অনেকেই প্যারাগ্লাইডিং করেছে ইসরাইলে ঢুকেছে (ফুটেজে দেখা গেছে অন্তত ৭ হামাস যোদ্ধা এভাবে ইসরাইলে ঢুকেছে)। আবার কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ইসরাইলের ভেতরে প্রবেশ করেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা সৈকত দিয়ে দুই দফায় হামাসের অনুপ্রবেশের চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে।

স্থানীয় সময় সকাল ৫টা ৫০ মিনিটে হামাসের সামরিক শাখা টেলিগ্রাম চ্যানেলে হামলার প্রথম ছবি প্রকাশ করে। স্থানটি ছিলো গাজা ক্রসিংয়ের সর্বদক্ষিণে কেরেম শালম। ওই ছবিতে একটি চেকপোস্ট দিয়ে হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইলে ঢুকতে দেখা গেছে। এ সময় অন্তত দুজন ইসরাইলি সেনার লাশ মাটিতে পড়ে ছিল। আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, পাঁচটি মোটরসাইকেলে চেপে সশস্ত্র যোদ্ধারা কাটাতাঁরের বেড়া পার হয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করছে। জায়গাটি আগেই কেটে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন যোদ্ধা ছিল। তাঁদের কাঁধে রাইফেল দেখা গেছে। এক জায়গায় বুলডোজার দিয়ে বেড়া ভাঙতে দেখা গেছে। এ সময় সেখানে কয়েক ডজন নিরস্ত্র মানুষ ছিলেন। বেড়া ভেঙ্গে ফেলার পর খোলা জায়গা দিয়ে তারা দৌঁড়ে ইসরাইলে ঢুকে পড়েন। কেরেম শালম থেকে ৪৩.৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরেজ নামের গাজা ক্রসিংয় দিয়ে দল বেঁধে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে ঢোকেন।
হামাসের প্রচার শাখার একটি চ্যানেলে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে একটি কংক্রিটের প্রাচীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। যেকোনো হামলার আগেই ইসরাইলের ওই চেকপোস্ট থেকে বার্তা দেওয়া হতো।

ভিডিওতে দেখা গেছে, একদল যোদ্ধা বিস্ফোরণ স্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। রাইফেল হাতে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পড়া আটজন যোদ্ধাকে সেদিকে দৌড়ে যেতে দেখা যায়। একপর্যায়ে চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরে চেকপোস্টের মেঝেতে ইসরাইলি সেনাদের দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। হামাস যোদ্ধারা একটার পর একটা কক্ষ টার্গেট করেছিল। ভিডিও দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত। গাজায় সাতটি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে। আর বাকি ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ মিশরের হাতে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের ঢোকার রাস্তা বের করে ফেলে।

ইসরাইলের অনেক ভেতরে হামলা চালানো হয়েছে : হামাস যোদ্ধারা গাজার সবগুলো ক্রসিং দিয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করেছে। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, তারা অন্তত ২৭টি স্থান থেকে হামলা চালিয়েছে। তারা চোখের সামনে যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে। তারা গাজা থেকে সাড়ে ২২ কিলোমিটার দূরে ওফাকিম শহরেও হামলা করেছে।

গাজা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ইসরাইলের শহর এসদেরতে হামলা করেছে হামাস। একট পিকআপ ট্রাকে করে শহর চষে বেড়িয়েছে তারা। ভেঙে ফেলা ইরেজ ক্রসিংয়ের উত্তরে অবস্থিত আশকেলন শহরের খালি রাস্তায় অন্তত এক ডজন যোদ্ধাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভিন্ন শহরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে হামাস যোদ্ধারা। রেইম শহরের কাছে একটি সংগীত উৎসবে বন্দুকধারীরা গুলি চালায়। মরুভূমিতে আয়োজিত ওই সংগীত উৎসবে একদল তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছিল।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেছেন যে, কীভাবে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি ভ্যানে করে তিন ঘণ্টা হামাস যোদ্ধারা শহর চষে বেড়িয়েছে। এ সময় তারা হামলা করার জন্য ইসরাইলিদের খুঁজছিল।

গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় জাতিসংঘের স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত : ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় জাতিসংঘের একটি স্কুলে ইসরাইলি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে। স্কুলটিতে শিশু, বৃদ্ধসহ শত শত বেসামরিক মানুষ অবস্থান ছিল। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইসরাইলের এই হামলাকে ‘নৃশংস’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে যে, স্কুলটি ‘ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে’। তবে এতে কেউ নিহত হয়নি।

৩ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রির ঘোষণা ব্যাংক অব ইসরাইলের
ডেইলি সাবাহ জানিয়েছে, ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল ঘোষণা করেছে যে, তারা খোলা বাজারে ৩ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করবে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে শেকেল এক্সচেঞ্জের অস্থিতিশীলতা কমাতে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমবার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শেকেল প্রাথমিক ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের সাথে সাথে এ পদক্ষেপটি বাজারকে দ্রুত স্থিতিশীল করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, তারা বাজারে বিনিময় পদ্ধতির মাধ্যমে ১৫শ’ কোটি ডলার পর্যন্ত অর্থ সরবরাহ করবে। এ ঘোষণার আগে, শেকেল ২ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছিল যার ফলে প্রতি ডলারে সাড়ে ৭ বছরে সর্বনিম্ন হার ৩ দশমিক ৯২-এ দাঁড়িয়েছিল। শেকেল এখন ০.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৩ দশমিক ৮৬ হারে দাঁড়িয়েছে।

ইসরাইলে ২০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে, যার বেশিরভাগই বৈদেশিক মুদ্রা কেনা থেকে বিরত রাখার এবং দেশের প্রযুক্তি খাতে বিদেশী প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে রফতানিকারকদের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার জন্য ২০০৮ সাল থেকে কেনা হয়েছিল।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button