Hot

মালয়েশিয়ায় বেনজীরের ‘সেকেন্ড হোম’, বিদেশে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি

স্বাস্থ্যের বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠুর সঙ্গে ব্যবসা, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁওয়ে শত বিঘার পোলট্রি খামার

মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের অধীনে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ।

দেশ থেকে অর্থ নিয়ে সেখানে আবাসন খাতে লগ্নি করেছেন তিনি। কিনেছেন বাড়ি। সিঙ্গাপুরে স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে মালয়েশিয়ার ওই বাড়িতে গিয়েই আপাতত সপরিবারে বসতি গেড়েছেন।

মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকে তার অর্থ লেনদেনের সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণও আছে। দেশে-বিদেশে বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম।

এদিকে দেশেও বেনজীরের আরও সম্পদের বিষয়ে তথ্য পাচ্ছে দুদক। সংস্থাটির কাছে অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজে বিতর্কিত হয়ে দেশজুড়ে আলোচিত নাম মোতাজেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে বেনজীর আহমেদের ব্যবসা রয়েছে বলে জানা গেছে।

উত্তরাঞ্চলের দুটি জেলায় কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন তারা। তার মধ্যে অন্তত তিনটি জায়গায় শত বিঘার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ‘নর্থ পোলট্রি খামার’। মুরগির খাদ্যের ব্যবসাও আছে তাদের। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।

বেনজীরের দুর্নীতি ও সম্পদের পাহাড় সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেউ অন্যায় করলে তার শাস্তি দেশের আইন অনুযায়ী হবে। বেনজীরের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তিনি অন্যায় করেছেন, নাকি নির্দোষ, তিনি কি কর ফাঁকি দিয়েছেন, নাকি অন্যভাবে অর্থ সম্পদ গড়েছেন-তদন্ত শেষ হলেই সে অনুযায়ী বিচার করা হবে।’

তদন্ত চলমান অবস্থায় বেনজীরের দেশ ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে দেশে আছে, নাকি বিদেশে চলে গেছে এটা আমি জানি না।’

দুদকের অনুসন্ধান ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিআইএফইউ) বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে অর্থ নিয়ে মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনার সুযোগ নেই। যারা সেখানে বাড়ি কিনেছেন তারা মূলত টাকা পাচার করেছেন। এক্ষেত্রে বেনজীর আহমেদও তার ব্যতিক্রম নয়।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ার স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি রতনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেনজীর আহমেদের। তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে দেন মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক এজিএম সাব্বির।

এই ক্লাবের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ আয়ের অন্যতম কুশীলব এই সাব্বির। তার মধ্যস্থতায় রতনের মাধ্যমে বিপুল টাকা পাচার করেছেন বেনজীর আহমেদ।

এছাড়া মালয়েশিয়ার হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ন কবিরের মাধ্যমেও বিপুল টাকা পাচার করেন বেনজীর আহমেদ। জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে মূলত জমজমাট হুন্ডি কারবার করেন হুমায়ন। কুয়ালালামপুরের সিচুয়াংসায় তার অফিস। হুমায়ন ও রতনের মাধ্যমে পাচার করা টাকায় পরিবারের থাকার জন্য একটি অত্যাধুনিক বাড়ি কিনেছেন বেনজীর। বিনিয়োগ করেছেন আবাসন খাতে।

রতন এখন ইউরোপের একটি দেশে এবং সাব্বির যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। হুমায়ন আছেন মালয়েশিয়ায়। বিএফআইইউয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বেনজীরের সম্পদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে দুদক কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার ২০০২ সালে ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি চালু করে। এর আওতায় মালয়েশিয়ার ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ (প্রায় দুই কোটি টাকা) অর্থ জমা রেখে অন্য দেশের একজন নাগরিক দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও অন্যান্য সুবিধা পান। তারা সেখানে বাড়ি কিনতে পারেন। বিনিয়োগ করতে পারেন ব্যবসা-বাণিজ্যে।

এই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের অনেকের মতো বেনজীর আহমেদও সেখানে বিনিয়োগ করেছেন। বেনজীরের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর গত ৪ মে তিনি সপরিবারে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন। সেখানে স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করতে পারেন।

জানা গেছে, দেশে-বিদেশে বেনজীরের সম্পদের তথ্য খুঁজতে গিয়ে নতুন আরও কিছু তথ্য পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বড় খোজাবাড়ি এলাকায় বিশাল পোলট্রি খামার রয়েছে। স্বাস্থ্যের বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠুর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় গড়ে তোলা এই খামারের নাম ‘নর্থ পোলট্রি খামার’।

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে ভিন্নজগৎ পার্কসংলগ্ন এলাকায় একই নামে রয়েছে আরেকটি খামার। এই খামার উদ্বোধনের সময় বেনজীর আহমেদ ও মিঠু উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া কিশোরগঞ্জ উপজেলার ধরেয়ার বাজার এলাকায় আরও একটি খামার রয়েছে। এসব খামারের নামে-বেনামে কয়েকশ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মিঠুর ভাই মানিক হাজি এই খামারগুলো দেখাশোনা করেন।

প্রসঙ্গত, আইজিপি থাকাকালে বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও পুলিশের অনুষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী কড়া বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় থাকতেন বেনজীর আহমেদ। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ভালোই ছিলেন তিনি।

কিন্তু গত এপ্রিল মাসে তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল সম্পদের তথ্য তুলে ধরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর তার সম্পদের অনুসন্ধানের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও তার সম্পদের তদন্ত করতে দুদকে আবেদন জানান। এরপর এ সংক্রান্ত তিন সদস্যের টিম গঠন করে কমিশন। এই টিমের প্রাথমিক অনুসন্ধানেই বেনজীর ও তার পরিবারের হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হয় দুদক।

গত ২৩ ও ২৬ মে দুদকের দুই দফায় করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের (ক্রোক) নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। ২৩ মে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা প্রায় ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের নামে এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ২০৫ একর সম্পদের মধ্যে ১৪২ একর (৪৬৮ বিঘা) রয়েছে স্ত্রী জিসান মির্জার নামে। গত ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, সাভারের একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরের ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে।

সেই সঙ্গে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দুই দফা মিলিয়ে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া আদালতের নির্দেশে গত সোমবার পুঁজিবাজারের ইলেকট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণাগার সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা সব বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) ফ্রিজ করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এই আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় হিসাবগুলোয় শেয়ার ও অর্থ লেনদেন করা যাবে না। আদালতের অন্যান্য আদেশও কার্যকর করা শুরু হয়েছে। আর দেশের বাইরের সম্পদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিএফআইইউর মাধ্যমে আমেরিকা, কানাডা ও দুবাইয়ের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের ব্যাংক হিসাব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পে তার বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে দুদক।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button