Bangladesh

মালিকদের সম্পদ বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না, বিলাসিতা কমিয়ে শ্রমিকদের দিকে নজর দিন: কারখানা মালিকদের প্রধানমন্ত্রী

মহান মে দিবস, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। তবে এ দিনে অধিকার আদায় হোক বা না হোক শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্র আরও বেশি স্পষ্ট হয়। একইসাথে স্পষ্ট হয় মুনাফালোভী মালিকদের চরিত্রও। দিনের পর দিন এ দেশের শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে বঞ্চিত, অপমানিত ও নির্যাতিত হয়। শ্রমিকদের পরিবারের আহার জোটাতে গিয়ে কত যে শ্রমিক কর্মস্থলেই মারা যান তার সঠিক হিসেব নেই। মারা যাওয়ার পর এই শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পান না ঠিক যেমন জীবিত অবস্থায় তারা পান না সঠিক মজুরী।

শুধু তাই নয় নিজ কর্মস্থলেই শ্রমিকরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় তাদের বেতন। কর্মস্থলে নারী শ্রমিকদের হতে হয় যৌন নির্যাতনের শিকার। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও জাতীয় মজুরি কমিশন গঠিত হয়নি। দিন রাত পরিশ্রম করে শ্রমিকরা যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চলে না। বিপরীতে মালিকের সম্পদ দিনে দিনে বাড়ছেই। যার একটা গাড়ি ছিল তার ৫টা হয়েছে। ৩টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ টা হয়েছে। ৫ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা মালিক এখন শত কোটি টাকার মালিক। কিন্তু যেই শ্রমিকদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে বিত্তশালী হন মালিকরা তাদের জীবনমানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। ন্যূনতম মজুরি নেই ৫০টির বেশি খাতে।

স্বাধীনতার ৫ দশক পর দেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী ভিত পেয়েছে তাতে এই শ্রমিকদের অবধান সবচেয়ে বেশি।  শ্রমিকের ওপর ভর করেই শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনীতি যতটা শক্তিশালী হয়েছে আয় বৈষম্য বেড়েছে তারচেয়েও অনেক বেশি-এমনি অভিমত অর্থনীতির বিশ্লেষকদের।

রোদে পোড়ে বৃষ্টিতে ভেজে মহাজনের ঋণ নিয়ে বগুড়ার যে শ্রমিক বেগুন উৎপাদন করেন তিনি যে দাম পান তা দিয়ে উৎপাদন খরচ ওঠে না। অথচ একই বেগুন ঢাকায় বিক্রি হয় বহুগুণ বেশি দামে। যেই কৃষক ধান চাষ করে সংসার চালাতে পারেন না সেই কৃষকের ধান মজুত করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্টকে রেখে দাম বাড়িয়ে বহুগুণ লাভ করেন মিল মালিকরা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস মালিকরা জমার টাকার (চুক্তির টাকা) পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। এতে মালিকের মুনাফা বাড়লেও পরিবহন শ্রমিকদের আয় বাড়ে না। তাদের প্রতিদিন ই জীবন যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। রাস্তায় গাড়ি চালাতে যে চাঁদা দিতে হয় তাও এই শ্রমিকরা বহন করেন আবার অ্যাক্সিডেন্টে মারাও যান বাসের চালক কিংবা সহকারীরা। মালিকের কোনো লস নেই ঝুঁকি নেই মালিক কেবলই রক্তচূষা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি মৌলিক শক্তির মধ্যে রয়েছে কৃষি, রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্ট। তিনটি শক্তির সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। তৈরি পোশাক, কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিদিনই নতুন শ্রমশক্তি আসছে। তারাই তাদের মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা সেভাবে মজুরি পাচ্ছেন না। এখনো দেশে ৫০টির বেশি খাতে ন্যূনতম মজুরি নেই। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়,একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির বিশাল পার্থক্য। কোনো খাতের মজুরি ২ হাজার টাকা, আবার কোনো খাতে ১৬ হাজার টাকার বেশি। তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা।

অথচ এই টাকা দিয়ে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের সংসার ঠিকমতো চলে না। কিন্তু মালিকের সম্পদ দিনে দিনে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক দিনে দিনে শোষিত হচ্ছে তার মজুরী বৈষম্যের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে বিপরীতে মালিক শ্রেণির সম্পদের পরিমান পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কল-কারখানা মালিকদের প্রতি বিলাসিতা কিছুটা কমিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে শ্রমিকরা তাদের কঠোর শ্রম দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে মালিকদের জীবন জীবিকা উন্নত করা অথবা বিলাসবহুল জীবন-যাপনের সুযোগ করে দিচ্ছে সেখানে তারা বিলাসিতা একটু কমিয়ে শ্রমিকদের দিকে বিশেষভাবে নজর দেবেন সেটাই আমি চাই।

আজ বুধবার (১ মে) অপরাহ্নে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ঐতিহাসিক মহান মে দিবসের আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

কভিড-১৯ মহামারি সময় মালিকদের প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান এবং মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ প্রদানের উল্লেখ করে তিনি জানান, কলকারখানা এবং উৎপাদন যেন অব্যাহত থাকে সে জন্য এটি তাঁর সরকার করেছে এবং মালিকরা ধীরে ধীরে তা শোধ করছেন।

কাজেই এর পেছনে সরকারের ভর্তুকি রয়েছে।

সরকার প্রধান বলেন, ‘আমি জানি বাংলাদেশে কিছু ভাড়াটে লোক কথায় কথায় শ্রমিকদের নিয়ে রাস্তায় নামার চেষ্টা করে। এখন যে কারখানা আপনাদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করছে কাজের ব্যবস্থা করছে জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করছে এই কারখানা নিজেরা যদি ধ্বংস করতে যান, ভাঙচুর করেন তাহলে ক্ষতিটা কার হচ্ছে? এতে নিজের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, পরিবারের ক্ষতি হচ্ছে তেমনি দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। মালিকদেরও ক্ষতি হচ্ছে।

কিন্তু মালিকদের তো আর একটা ব্যবসা থাকে না আরো অনেক ব্যবসা থাকে। তারা হয়ত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু আপনাদের নিজেদের ক্ষতি তো আপনারা নিজেরা করেন।’

ধাপে ধাপে গার্মেন্টস শ্রমিক মজুরি মাত্র ৮০০ টাকা থেকে ১৬০০ এবং পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালে তা ১২ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির দাবির জন্য, কথা বলার জন্য আমরা তো আছি।

আমরা তো বলি। আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী নই, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি সেই ভাবেই নিজেকে বিবেচনা করি। আপনাদের যদি কোনো অসুবিধা হয়, আমার দুয়ার আপনাদের জন্য সবসময় খোলা। আপনার আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

সে গুলো আমরা দেখব এবং আমাদের শ্রমিক সংগঠনও রয়েছে।’

শ্রমিকদের শুধু নয় কৃষক, এমনকি বর্গা চাষীদের বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের সুযোগ তাঁর সরকার করে দিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘শিশু শ্রম বন্ধের উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। আজকে শতকরা ৯৮ শতাংশ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। আমরা তাদের বৃত্তি দিচ্ছি, খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বিনা মূল্যে বছরের প্রথম সপ্তাহে বই দিচ্ছি এবং কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য ব্যাপকহারে বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। এটা আগে ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর আমরা করেছি। যাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমাদের বেকারের সংখ্যা ৩ শতাংশ নেমে এসেছে। যা প্রায় ২ থেকে ৩ গুণ বেশি ছিল। কর্মসংস্থান ব্যাংকের উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য যুবকদের বিনা জামানাতে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছি। কোনো সমস্যা হলে সেটা বলবেন কিন্তু কারো প্ররোচনায় বা কারো উস্কানিতে যেটা থেকে নিজের রুটি-রুজি ও ভাত কাপড় আসবে সেটাকে যেন ধ্বংস করা না হয়। সেটার প্রতি আপনারা অবশ্যই যত্মবান হবেন। আর মালিকদেরকে বলব আপনারা আপনাদের বিলাসিতার কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণ দেখবেন।’

তিনি এ সময় ক্রেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন তো সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কাজেই আপনারা যদি পণ্য মূল্য কিছুটা বাড়িয়ে দেন, তাহলে আমি নিজেও মালিকদের আরো চাপ দিতে পারি আমাদের শ্রমিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। আমি আশা করি আইএলও শুধু শ্রমিক নয়, মালিকদের এই বিষয়ও দেখবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পায় না কিন্তু বাংলাদেশে পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের কর্মজীবী মহিলার সংখ্যা ৪৩.৪১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ছিল মাত্র ২২.৮১ ভাগ। এখন মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে কাজ করতে পারছে, সে সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী এর আগে কয়েকটি শ্রমিক পরিবারের নিকট আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন। পরে তিনি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এইচ এম ইব্রাহিম, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তুওমো পুতিয়ানেন, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি আরদাশির কবির ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নান আলোচনায় অংশ নেন। স্বাগত বক্তব্য প্রদান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button