মুখ থুবড়ে পড়ছে পাকিস্তানকে একঘরে করার ভারতের কৌশল

দুই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তির অর্থ হলো, পাকিস্তান এখন তালেবান ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তদারকির দায়িত্বে এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী নীতিমালার আলোচনায় নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে।
পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে। এতে ইসলামাবাদকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করার বহুবছরের নয়াদিল্লির সাধনা এবং কৌশল এখন অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। বিষয়টি ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে জোরালো প্রশ্নে সরব হয়েছে অনেকেই।
ভারতীয় দৈনিক ডেকান হেরাল্ডে এ নিয়ে আরও লিখেছেন মুক্ত সাংবাদিক নিরুপমা সুব্রামনিয়াম। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত তড়িঘড়ি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে একগুচ্ছ কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়। ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের প্রাণহানি এবং ভয়াবহ সহিংসতার পর মোদি সরকার দাবি করে, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং তাদের সক্রিয় মদদদাতা।
কিন্তু একই সময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের আকস্মিক উত্থান ভারতের এসব কুট-কৌশলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। পাকিস্তানকে নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৮৮ স্যাংশন কমিটির চেয়ারম্যান এবং কাউন্টার-টেররিজম কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তির অর্থ হলো, পাকিস্তান এখন তালেবান ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তদারকির দায়িত্বে এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী নীতিমালার আলোচনায় নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে পাকিস্তানে এই মর্যাদা প্রাপ্তি উদ্বেগ, বিরক্তি ও চরম হতাশা তৈরি করেছে।
কাশ্মীর উপত্যকার জনপ্রিয় পর্যটনস্থল বাইসারান মেডোতে চালানো হামলার দায় স্বীকার করে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) — যেটি জাতিসংঘ স্বীকৃত নিষিদ্ধ সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যবা (এলইটি)-র একটি সংগঠন বলে দাবি করা হয়। ভারতীয় দাবির স্বপক্ষে কোনও জোরাল প্রমা্ণ তুলে ধরতে পারেনি নয়াদিল্লি।
এই ঘটনার পরপরই ভারত জোরদার কূটনৈতিক কুচকাওয়াজও শুরু করে। পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিসরি জি-২০ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে ‘আন্ত-সীমান্ত সন্ত্রাস যোগসুত্র’ বা “ক্রস-বর্ডার টেরর লিঙ্ক” সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি ৩৩টি দেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠান। এ দলভুক্ত ছিলেন শশী থারুর, রবি শংকর প্রসাদ, প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর মতো রাজনীতিকরা ছিলেন। তাঁদের দায়িত্ব ছিল বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ তুলে ধরা এবং ভারতের অবস্থানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।
সামরিক দিক থেকেও মোদি সরকার চুপ থাকেনি। “অপারেশন সিঁদুর” নামে চালানো এক সামরিক অভিযানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এই অভিযানকে অনেকেই ২০১৯ সালের বালাকোট হামলার পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখেছেন। তবে কূটনৈতিক প্রচারণা, তৎপরতা, সামরিক পদক্ষেপ— সবকিছু সত্ত্বেও জাতিসংঘে পাকিস্তানের মর্যাদা বৃদ্ধিই দেখিয়ে দিল ভারতের পাকিস্তানকে একঘরে করার কৌশলের সীমাবদ্ধতা। হয়ত কৌশলটি আতুরেই মারা গেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের জন্য পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয় । এরপরই তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদেও মনোনীত হয়েছে।
এ দুটি পদ হলো, ১৯৮৮ স্যাংশন কমিটির চেয়ারম্যান। এই কমিটি মূলত তালেবান, আল-কায়েদা, আইএসআইএল-সহ বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তদারক করে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সম্পত্তি জব্দ এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। দ্বিতীয় পদটি হলো, কাউন্টার-টেররিজম কমিটির ভাইস-চেয়ার।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নজিরহীন হামলার পর গঠিত এই কমিটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
কখনো কখনো সরেজমিনে মূল্যায়নও চালায়। এই নিয়োগগুলো হয়ে থাকে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। পাকিস্তান বলছে, এসব পদ পাওয়ার অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক মহল এখন তাদের সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু ভারতের হৃৎপিণ্ডে এ এক বড় ধরণের ধাক্কা। দেশটিতে যা ক্ষোভ, হতাশা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক মহলে এই ঘটনা রীতিমতো ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে একে “অগ্রহণযোগ্য ও দুর্ভাগ্যজনক” বলে অভিহিত করেন। শিবসেনা (ইউবিটি) সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, “যে দেশে ৫২ জন জাতিসংঘ-তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী রয়েছে, সে দেশকে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির ভাইস-চেয়ার বানানো আর মাসুদ আজহারকে শান্তির দূত বানানোর নামান্তর।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারত আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে একচুলও সরবে না।
এদিকে জাতিসংঘে ভারতের কূটনীতি চ্যালেঞ্জে মুখে পড়েছে। পেহেলগাম হামলার তিন দিন পর, ২৫ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে হামলার নিন্দা জানায় এবং ভারত ও নেপালকে সমবেদনা জানায়। বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদকে “আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি” বলা হয়। কিন্তু এতে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট বা লস্কর-ই-তৈয়্যবা-র নাম নেই, এমনকি পাকিস্তানের ভূমিকারও উল্লেখ করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান তখন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য এবং তাদের পাশে ছিল চীন। ফলে বিবৃতির ভাষা ছিল ঘোলাটে এবং নিরপেক্ষ। এর ফলে ভারতের অভিযোগ হালে পানি বা যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। ৫ মে অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার বিষয়টি তুললেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কয়েকজন সদস্য অবশ্য পাকিস্তান-অধিকৃত অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতিনিধিদের কড়া প্রশ্ন করেন। চীন স্পষ্টভাবে বলে দেয়, কাশ্মীর ইস্যু জাতিসংঘ সনদ, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশী থারুর বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে প্রস্তাব তুলবে না, কারণ চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভেটো দেবে এবং বহু দেশ ভারতের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপে আপত্তি জানাবে।
নয়াদিল্লির তৎপরতাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের পাল্টা কূটনীতিও শুরু হয়েছে। ভারতের প্রচারণার জবাবে পাকিস্তানও এক পাল্টা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অভিযান শুরু করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের নেতৃত্বে বিভিন্ন পশ্চিমা রাজধানীতে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়। তারা পেহেলগাম হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত নেই বলে প্রচার করে এবং ভারতের “অপারেশন সিঁদুর”-কে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে দাবি করে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্তে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি, পাকিস্তান অভিযোগ তোলে যে ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি ভঙ্গ করে চেনাব নদীর পানি প্রবাহ কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারতে এই তৎপরতা পাকিস্তানি পাঞ্জাবের কৃষিতে প্রভাব ফেলছে।
পাকিস্তান ওআইসি (অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন)-এর সহায়তায় জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিকীকরণে সচেষ্ট । ওআইসি বিবৃতিতে বলে, কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এখনও মেনে নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে কোনও দেশ, জাতি, ধর্ম বা সংস্কৃতিকে দায়ী করা উচিত নয়।
ভারত ওআইসির বক্তব্যকে সরাসরি পাকিস্তানের প্ররোচনায় গৃহীত “অযৌক্তিক ও পক্ষপাতদুষ্ট” বিবৃতি বলে খারিজ করে দিয়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং জাতিসংঘে পাকিস্তানের ভূমিকায় ভারত যে কূটনৈতিক চাপে রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নিরুপমা আরও মনে করেন, ভারত সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে কঠোর থাকলেও, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় আদর্শ আর কৌশল এক পথে হাঁটে না। নতুন করে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে ভাবতে হবে— শুধু পাকিস্তানকে একঘরে করলেই সমাধান নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক মিত্রতা গড়ার কৌশল হতে হবে আরও জোরালো, আরও পরিশীলিত।