মুদ্রানীতি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন
মধ্য জুলাই যখন দেশে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত অবস্থা, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রকার নীরবে-নিভৃতে তাদের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ধাপের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এবারের মুদ্রানীতি দেশের ক্রান্তিকালে যেভাবে ঘোষণা করা হয়েছে তা মোটেই ঠিক হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে দুবার তাদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। সে অনুযায়ী জুলাই মাসে বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ধাপের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু দেশে যেহেতু একটি অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল এবং সবার দৃষ্টি যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে দেশের মানুষ, বিশেষ করে যাদের জন্য এই মুদ্রানীতি প্রয়োজন তাদের কাছে এটি পৌঁছায়নি। অথচ বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে মুদ্রানীতি ঘোষণার বিষয়টি কিছুদিন পেছানো যেত এবং সেটাই উচিত ছিল।
এবারের মুদ্রানীতিতে বংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে।
এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের রেপো নীতি সুদহার ৮.৫০ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। সেই সঙ্গে এসডিএফ হার ৭ শতাংশ এবং এসএলএফ হার ১০ শতাংশ ও অপরিবর্তিত রেখেছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য সুদহার বহির্ভূত যে নীতি ও ব্যবস্থা আছে সেগুলোও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হবে বলে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। আমাদের দেশে মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই। তার পরও প্রতিবারই বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখন ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় সেটাই দেখার বিষয়।
এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা না করে, নীরবে তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সাংবাদিকদের একটা পার্থক্য তৈরি হয়ে আছে। আর এর প্রতিবাদে সাংবাদিকরা গভর্নরের সংবাদ কভার করা থেকে বিরত আছেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিকদের এড়িয়ে তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এবারের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়টি অনেক আগেই মিটিয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সে রকম কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অতিমাত্রার ইগো এবং হামবড়া ভাব থাকলে যে কী করুণ পরিণতি হয় তার বড় উদাহরণ বর্তমান বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সাংবাদিকদের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়টি দ্রুত মিটিয়ে ফেলা, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নীতি ও সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছায়।
প্রতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদ সম্মেলন করে তাদের ঘোষিত মুদ্রানীতি প্রকাশ করে এবং সেখানে মুদ্রানীতির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। সাংবাদিকরা মুদ্রানীতির অনেক বিষয় নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করে। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সাংবাদিকরা ঘোষিত মুদ্রানীতি নিয়ে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেন, অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের মতামত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন। এসব প্রতিবেদন থেকেই দেশের মানুষ, বিশেষ করে মুদ্রানীতি প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ভালোভাবে জানতে পারেন। সবার পক্ষে পুরো মুদ্রানীতি পড়ে সব কিছু জানা সম্ভব নয়। ফলে সাংবাদিকরা ঘোষিত মুদ্রানীতি নিয়ে যে প্রতিবেদন এবং মতামত প্রকাশ করেন সেখান থেকেই মুদ্রানীতির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জানা যায়। কিন্তু এবার সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করার মানুষ সেভাবে জানতেই পারেনি।
মুদ্রানীতি ঘোষণার দুটো প্রভাব থাকে, যার একটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি প্রভাব এবং আরেকটি হচ্ছে পরোক্ষ বা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়, সেগুলো দেশের আর্থিক খাতে প্রয়োগ করলে দেশের মুদ্রাবাজারে কিছু প্রভাব পড়ে, যাকে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ প্রভাব বলা হয়ে থাকে। যেমন—মুদ্রানীতিতে যদি নীতি সুদহার হ্রাস করা হয় এবং দেশের মুদ্রাবাজারে যখন এই নতুন নীতি সুদহার প্রয়োগ করা হবে, তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস পাবে। এর ফলে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে যাবে, যা মূলত মুদ্রানীতির সরাসরি বা প্রত্যক্ষ প্রভাব। এর বাইরে যখন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় এবং সেই ঘোষিত নীতি নিয়ে যখন বিভিন্ন মাধ্যমে বিস্তারিত আলোচনা হয় তখন মানুষের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। যেমন—মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হলে বিষয়টি নিয়ে যখন বিস্তারিত আলোচনা হবে তখন মানুষ উচ্চ সুদের হারের আশায় খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকবে বা উচ্চ সুদের হারে কম ঋণ নিয়ে খরচ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। মুদ্রানীতির এই দিকটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব, যা সংবাদপত্র বা মিডিয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয়।
আমাদের দেশের মুদ্রাবাজার যেহেতু সে রকম ম্যাচিউরড নয়, তাই বিষয়টি সেভাবে বোঝা যায় না। কিন্তু উন্নত বিশ্বসহ যেসব দেশে ম্যাচিউরড মুদ্রাবাজার আছে, সেখানে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই কাজ করে। আর এ কারণেই সেসব দেশে বেশ ঘটা করে এক ধরনের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। আমাদের দেশে মুদ্রানীতির এই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সেভাবে কাজ করুক আর না করুক, প্রতিবারই ঘোষিত মুদ্রানীতি নিয়ে সাংবাদিকরা বিস্তারিত প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করায় মানুষ অন্তত জানতে পারে। কিন্তু এবার সাংবাদিকদের না জানিয়ে শুধু ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মুদ্রানীতি প্রকাশ করায় মুদ্রানীতি ঘোষণার আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। ঘোষিত মুদ্রানীতি মানুষের গোচরে, বিশেষ করে যাঁরা বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করবেন তাঁদের দৃষ্টিতে আনা অপরিহার্য।
যেহেতু নতুন সরকার গঠনের পর নতুনভাবে আর্থিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, তখন তার ভিত্তিতেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। তাই বর্তমানে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে কোনো রকম পরিবর্তনের সুযোগ সেভাবে নেই। যে মুদ্রানীতি নীরবে-নিভৃতে ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি এখন প্রতিবারের ন্যায় সাংবাদ সম্মেলন করে যথাযথভাবে ঘোষণা করা প্রয়োজন। এতে মানুষ জানতে পারবে। যাঁরা এই মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত তাঁরা জানতে পারবেন। ফলে কিছুটা হলেও দেশের মুদ্রাবাজারে ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে।