Bangladesh

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি: অনেক দেশেই নিয়ন্ত্রণে, বাড়ছে বাংলাদেশে

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হারও। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। 

অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকাও ইতোমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিকে বাগে আনতে পেরেছে। অনেক দেশই মূল্যস্ফীতিকে নিম্নমুখী করেছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ এখনো চড়া মূল্যস্ফীতির হারকে বাগে আনতে পারেনি। উলটো বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে যেখানে খাদ্য উৎপাদন হয়, সেখানে অর্থাৎ গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, যা ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। শহরে এ হার ১২ দশমিক ১১ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী যেখানে পণ্য উৎপাদন হয়, সেখানে দাম কম থাকে। যেখানে সরবরাহ করা হয়, সেখানে পরিবহণ ব্যয়, হাতবদলসহ নানা কারণে পণ্যের দাম বেশি থাকে। বাংলাদেশে এ নিয়ম অচল। এখানে উৎপাদনের স্থান গ্রামে দাম বেশি আর সরবরাহ স্থান শহরে কম। এটি উদ্ভট বিষয়। এর মানে এ নয় যে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি পাচ্ছেন। কৃষক কিন্তু ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অর্থাৎ, মুনাফার বড় অংশই লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী বা কথিত সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দেশে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মূলত চার কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এগুলো হচ্ছে- করোনার পর হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, দেশের বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন।

দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এর সঙ্গে একমত। তারা আরও মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া এবং পণ্যমূল্য নিয়ে কথিত সিন্ডিকেটের কারণেও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা, নেপাল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে এনেছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোও এ হার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেড়েই চলেছে।

যুক্তরাজ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশে উঠেছিল। গত মার্চে তা সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৮ শতাংশে ওঠে। আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত বছরের সেপ্টেম্বরে উঠেছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ। গত মার্চে তা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ১ শতাংশে ওঠে। আগস্টে কমে তা ৬ দশমিক ৯ শতাংশে নেমেছে।

দুটি দেশই গত বছরের মে থেকে খাদ্যের দাম বাড়তে থাকলে নীতি সুদের হার বাড়াতে থাকে। একই সঙ্গে মুদ্রানীতিকে সংকোচনমুখী করে বাজারে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে দেয়। এতে মানুষের চাহিদা কমে যায়। মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পড়ে। ওই সময়ে তারা স্বল্প-আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করে। ফলে তারা মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। একই পথ অনুসরণ করেছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল। ফলে তারাও সুফল পেয়েছে। শ্রীলংকায় করোনার পর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও। এতে মূল্যস্ফীতির হার কমতে থাকে। শ্রীলংকায় এখন পণ্যমূল্য বাড়ছে ২ শতাংশের কম।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত গড়ে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে ৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক দেশ বৃদ্ধির এ হার কমাতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। যে কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এছাড়া দেশে ডলার আয় এখনো বাড়ানো যায়নি। উলটো আরও কমে যাচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে টাকার মান। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। এ কারণে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অন্যান্য দেশের মতো নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু বাজারে ঋণের সুদের হার বাড়াতে দেয়নি। ব্যবসায়ীদের চাপে সুদের হার বাড়ানো হয়নি। একই সঙ্গে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি নিয়েও বাজারে সুদের হার বাড়াতে পারেনি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো সুফল বয়ে আনেনি। এতে মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। উলটো পণ্যের উৎপাদন বাড়লে সিন্ডিকেট করে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এবং দাম বাড়ানোর কারণে এ হার না কমে বরং ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তবে শীতে সবজিসহ সব পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়, সরবরাহও বাড়ে। ফলে শীতে এ হার কিছুটা কমতে পারে।

এ সঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতির সুদহার বাড়ালেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সুদের হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছে। এতে টাকার প্রবাহ কমছে না। ডলারের দাম ধরে রেখে সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ডলারের সরবরাহ বাড়লে টাকার অবমূল্যায়ন কমে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সহনীয় হতো; কিন্তু সেটি হয়নি।

অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ হার সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমেছে। মূল্যস্ফীতি না হয়ে উলটো রিফ্লেকশন বা মূল্য সংযোজন হচ্ছে। গত জুলাইয়ে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে দেশটিতে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এসে মাত্র ২ শতাংশের কম বেড়েছে।

ভারতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল এ হার ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। জুলাইয়ে তা কমে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। ভারত ডলারের বিপরীতে রুপির রেকর্ড অবমূল্যায়ন করেছে। খাদ্যপণ্য সরবরাহেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল, পেঁয়াজ, গমসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাজারে পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা এসেছে।

নেপালে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এখন তা কমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। ভুটানে গত সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ছিল দেড় শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ভারত বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি বন্ধ করায় ভুটানে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে দেশটিতে পণ্যের দাম বাড়ছে।

মালদ্বীপে গত মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৮ শতাংশে উঠেছিল। এখন কমে সাড়ে ৪ শতাংশ হয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও। এতে কমেছে ডলারের ওপর চাপ। যে কারণে এ হার কমছে।

পাকিস্তানে মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। চীনে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে এখন তা রিফ্লেকশন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। থাইল্যান্ডে ৯ দশমিক ৮ থেকে কমে এখন ১ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে জাপানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। দেশটিতে এ হার ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ১০ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে।

যুদ্ধে জড়িয়েও রাশিয়ার মূল্যস্ফীতির হার কমছে। দেশটিতে গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এখন তা কমে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও ইউক্রেনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমছে। গত বছরের অক্টোবরে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
bacan4d
bacan4d