Hot

মূল্যস্ফীতির সময়ে কেন এ গাড়িবিলাস?

মানুষকে নিয়েই সমাজ, আর সমাজকে নিয়ে রাষ্ট্র। একটি সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেককেই অবদান রাখতে হয়। তাই সমাজের সুবিধাভোগের বেলাতেও সবাই অধিকারের প্রশ্ন তুলতে পারে এবং তা দাবি করতে পারে।

কোনো কোনো সমাজে, কোনো কোনো সময় বিপর্যয় নামতে পারে, এটি আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু যা আমরা মানতে পারি না, তা হলো, সামাজিক বিভাজন। একটি সমাজের উৎপাদন কাজে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে বলা হবে, আর সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। সামাজিক সুবিধা ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত হওয়া উচিত। সবচেয়ে বেদনার কথা হলো, এ ‘উচিত’ কর্মটি আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয় না। আজকের এ বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক সমাজে একদিকে একটি বড় অংশ ভোগান্তির মধ্যে জীবনযাপন করছে, আর অপর ক্ষুদ্র অংশটি বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সমাজের এ বৈপরীত্য আমাদের পীড়া দেয় এবং মাঝে মধ্যে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে চায়।

কেমন আছি আমরা? এ প্রশ্নের উত্তর সবার একই হবে-ভালো না। সমাজের একটি বড় অংশের জীবনমান ভালো না হলে তাকে ভালো সমাজ বলা যায় না। একটি ক্ষুদ্র অংশের ভালো থাকাকে সামগ্রিক ভালো বলা যায় না। এ ভালো না থাকার প্রধান কারণ হলো আর্থিক সংকট। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ এখন দিশেহারা। বছরখানেক আগেও সরকারি মহল অত্যন্ত তৃপ্তিসহকারে মূল্যস্ফীতির জন্য করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে বক্তব্য দিত। এখন তা-ও দেয় না, কেননা, ওই বক্তব্যের সত্যতা ছিল না। দেউলিয়া রাষ্ট্র শ্রীলংকাতে ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এখন মাত্র ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের পেট খালি থাকলেও চোখ-কান খোলা। তারা দিন-দুনিয়ার খবর রাখেন। তাই মিথ্যা প্রচারণা দীর্ঘস্থায়ী করা দুঃসাধ্য কাজ।

বাংলাদেশে বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মূল্যস্ফীতি তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একজন মানুষ মাসে ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেও ৫ জনের একটি সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যাদের সঞ্চয়প্রবণতা ও সক্ষমতা ছিল, তারা এখন সেই সঞ্চয় ভাঙিয়ে খেতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ ধারদেনার দিকেও এগিয়েছেন। নিম্নআয়ের মানুষের অবস্থা তো আরও বেসামাল। একটা সময় ছিল মানুষ জীবিকার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাত। এ সময়ে ঘটছে চিরাচরিত প্রবাহের বিপরীত। এখন সংসারের ব্যয় সংকুলান করতে না পারার কারণে মানুষজন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন; কেউ কেউ পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে নিজে কোনোমতে শহরে ঠাঁই গুঁজেছেন। এর বাইরে যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অবস্থা আরও নাজুক। আমাদের নিত্যদিনে যেসব পণ্য আমরা ভোগ করি, তার মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি দেখলে নাজুক অবস্থাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রতি ডজন ডিম কিনতে আপনাকে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে ২৪ টাকা; কেজিপ্রতি দেশি মুরগিতে বাড়তি দাম দিচ্ছেন ১০০ টাকা, ব্রয়লারে দিচ্ছেন বাড়তি ১০ টাকা। চিনি কিনতে গিয়ে আপনাকে কেজিপ্রতি অতিরিক্ত দাম দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা; পেঁয়াজে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৪৫ টাকা, রসুনে ১৮০ টাকা, হলুদে ১৬০ টাকা, আদায় কেজিপ্রতি ২৮০ টাকা। আর মাছ ও গরুর মাংসে আপনাকে কেজিপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের অনাচার। মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বড়ানো হয়েছে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ। এ সময়ে গ্যাসের দাম দুই দফায় প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। কোনো পণ্যের দামবৃদ্ধির চেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। অর্থাৎ পণ্যে দামবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, আয় সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। পণ্যের দামবৃদ্ধির পাশাপাশি যদি আয় স্থির থাকে, তবে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে বাধ্য। আপনার আয় হলো মাসে ৪০ হাজার টাকা। আগে ৪০ হাজার টাকায় যেসব পণ্য ও সেবা কিনতে পারতেন, এখন তা ক্রয় করতে লাগবে ৪৫ হাজার টাকা। এ বাড়তি টাকা কোথায় পাবেন? স্বাভাবিকভাবেই আপনার ভোগ কমিয়ে দিতে হবে। তাই এখন সীমিত আয়ের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনে ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, যা স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় হিসাবে দেখা দেবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য আমার দেওয়া অনুমিত উদাহরণের চেয়ে আরও ভয়ংকর। ২০১০ সালে যে পরিবারে পণ্য ও সেবা ক্রয়ে খরচ করা হতো ১১ হাজার টাকা, একই পরিমাণ পণ্য ও সেবার দাম ২০১৬ সালে এসে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকাতে। আর ২০২৩ সালে সেই পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৫০০ টাকায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। এর বিপরীতে আয় বেড়েছে কত শতাংশ? সুতরাং, সাধারণ পণ্যমূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার লাগাম টানতে চাচ্ছে। তাই খুচরা বাজারে অত্যাবশ্যকীয় ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের এ সরাসরি হস্তক্ষেপেরও খুব একটা সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কেজিপ্রতি ৩৫-৩৬ টাকা, কিন্তু বাজারে ৪৫-৫০ টাকার নিচে আলু পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৪৮ টাকায় ১ হালি ডিম পাওয়া যাবে, কিন্তু দোকানিরা আরও ৪ টাকা বেশি নিচ্ছে। পেঁয়াজের বাজারদর সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে প্রায় ২০ টাকা বেশি। সরকার নির্ধারিত পেঁয়াজের দাম হলো কেজিপ্রতি ৬৪-৬৫ টাকা, অথচ বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। সয়াবিন তেলের দাম সরকার নির্ধারিত লিটারপ্রতি ১৬৯ টাকার জায়গায় ১৭০-১৭৪ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ। খোলা চিনিতেও সরকারি দামের সঙ্গে বাজারদরের কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা পার্থক্য দেখা যায়। রান্নার গ্যাসের দামে পার্থক্য রয়েছে অনেক। ১২ কেজির সিলিন্ডারের সরকার নির্ধারিত গ্যাসের দাম হলো ১ হাজার ২৮৪ টাকা, কিন্তু বাজার থেকে কিনতে গেলে দাম গুনতে হয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার ৪টি কারণ সংশ্লিষ্টরা চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো-এক. পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা। দেখা গেছে, যতক্ষণ বাজারে অভিযান চলে, ততক্ষণ বাজারে দাম কম থাকে; দুই. বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা; তিন. চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। সরবরাহ-সংকট থাকলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দর কার্যকর করা সম্ভব নয়; চার. বেড়ে যাওয়ার পর দর নির্ধারণে লাভ হয় না।

সাধারণ মানুষের এ দুর্ভোগের কারণ যদি বৈশ্বিক পরিস্থিতি হয়, তাহলে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ সংকটকালেও সমাজের ‘সুবিধাভোগী’ শ্রেণিস্বার্থ বজায় রেখে চলেছে। সরকার এক মুখে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে, আবার পরক্ষণেই বিলাসী ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ বৈপরীত্য আমাদের বিস্মিত না করে পারে না। সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ব্যয়বহুল গাড়ি ক্রয় করা হবে। ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কিনতে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রস্তাবে গত ২৭ আগস্ট অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার ডিসিরা পাবেন নতুন গাড়ি। ২০০টি গাড়ি কেনা হচ্ছে ইউএনওদের জন্য। তবে এখানে আবার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আগে ইঞ্জিন ক্ষমতা ২৭০০ সিসির গাড়ির অনুমোদন ছিল সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের। এবারে ইউএনওরা সেই সুবিধা পাবেন। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের জন্য গাড়ি কেনার অনুমতি চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। উপাচার্যদের জন্য কেনা এ গাড়ির খরচ পড়বে ২ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলীরাও গাড়ি চেয়েছে ৪৩৩টি। পুলিশের পক্ষ থেকেও ২২৬ কোটি টাকার গাড়ি কেনার কথা ভাবা হচ্ছে।

আমরা এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে আছি। দুই বছর আগেও আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ১৩ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি ডলারে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ১৭১ কোটি ডলার। দেশের আমদানি ব্যয় কমানো হয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এ সংকটময় মুহূর্তে ‘গাড়ি বিলাসিতার’ যৌক্তিকতা নিয়ে অধ্যাপক সেলিম রায়হানের বক্তব্য দিয়েই শেষ করব। তিনি বলেন, এখন ডলার সংকট চলছে। এ সময়ে গাড়ি কেনা অগ্রাধিকারে থাকা উচিত নয়। আর কঠিন সময় না হলে সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। প্রশ্ন উঠেছে, কারণ মানুষ কষ্টে আছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button