Hot

‘মৃত্যু’ সেলে নারীদের জীবনযন্ত্রণা

ফাঁসির আসামিদের সেলকে (কনডেম সেল) অনেকেই বলেন, কারাগারের ভেতর আরেক ‘কারাগার’। মৃত্যুদন্ড থেকে খালাস পেয়ে বাইরে আসা ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো, সেখানে বছরের পর বছর প্রতি মুহূর্তে শারীরিক ও মানসিকভাবে ‘মৃত্যু’ হয় আসামির। দেশের বিভিন্ন কারাগারের নির্জন সেই সেলগুলোর কয়েক ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ছোট কক্ষে বর্তমানে ৮২ জন নারী মৃত্যু আর জীবনের প্রহর গুনছেন। তাদের প্রায় সবাই হত্যা মামলার আসামি। আর কনডেম সেলে নারী আসামিদের এ সংখ্যা এখন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৫-১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বন্দি আছেন ৫৪ জন নারী।

এছাড়া দুটি কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় থাকা দুই নারী বন্দির সঙ্গে বড় হচ্ছে দুই শিশু। 

বিশ্বের যেসব দেশে মৃত্যুদন্ডাদেশ বেশি দেওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। কঠোর এ সাজা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক রয়েছে। নারীদের সর্বোচ্চ এ সাজা দেওয়া নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। তবে, দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসির সাজা কার্যকর হয়নি। বিচারিক আদালতে তাদের রায় হলেও হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে সাজা রহিত হয়ে হয় যাবজ্জীবন, অন্য মেয়াদের সাজা নয়তো খালাস।

তবে, মামলা নিষ্পত্তিতে বিচারিক আদালতে যেমন ধীরগতি রয়েছে, তেমনি উচ্চ আদালতেও ফাঁসির মামলা কমপক্ষে পাঁচ বছরের আগে নিষ্পত্তি হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় নারী আসামিদের জামিন নিয়ে শিথিলতা রয়েছে। একই আইনের ৩৮২ ধারা অনুযায়ী কোনো গর্ভবতী নারীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে না।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘প্রকৃত অপরাধীর বাইরে পরিস্থিতির কারণেও অনেক নারী আইনের ফাঁকফোকরে পড়ে যান। আর যে সব নারী কনডেম সেলে আছেন, তাদের অনেকের চূড়ান্ত বিচারে খালাস বা সাজা কমে যেত। কিন্তু বছরের পর বছর তাদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে। তাদের পরিবারগুলো ভুগছে। যে ফাঁসির সাজা কার্যকর হয় না সেটা দিয়ে লাভ কী? ফাঁসির সাজা দিয়ে কোনো দেশেই অপরাধ নিবৃত করা যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘দেখা গেল কোনো নারী কনডেম সেলে ৫-১০ বছর পার করে চূড়ান্ত বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন এখন এর দায় কে নেবে? তাদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণই-বা হবে কীভাবে?’

পাঁচ বছরে প্রায় দ্বিগুণ নারী কনডেম সেলে : কারা অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেলগুলোতে নারী বন্দি ছিলেন ৪৫ জন। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন ৬৩ জন। অর্থাৎ ১৫ মাসে বন্দি বেড়েছে ১৯ জন। দেশের আটটি বিভাগের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে কমপক্ষে ৫ বছর ধরে বন্দি আছেন ৩৯ নারী। অন্তত ১০ বছর ধরে আছেন ১৩ জন। এছাড়া ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন দুই নারী। গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে সবচেয়ে বেশি ১২টি সেলে ৩২ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নারী আছেন।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, ‘অভিযোগ যা-ই হোক, নারী আসামির জামিনের ক্ষেত্রে কিছু নমনীয়তা ও বিবেচনার সুযোগ আইনে আছে। কিন্তু বিচারে অপরাধের গভীরতাকে সমানভাবে বিবেচনা করা হয়। অনেক সময় বিচারকরা নারীর সন্তান, বয়স বিবেচনা করে শিথিলতা দেখান, সেটি ব্যতিক্রম। অপরাধ থাকলে বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিচারকদের অনেকের ব্যাপকহারে ফাঁসি দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে।’     

কনডেম সেলে যেমন কাটে নারীদের জীবন : কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত কনডেম সেলগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৮/১০ ফুটের মতো হয়। নারী বন্দিদের কক্ষগুলোতে দরজা, জানালা ও ছোট বারান্দাসহ টয়লেট, সিলিং ফ্যান ও লাইটের ব্যবস্থা রয়েছে। নির্ধারিত পোশাক, ঘুমানোর জন্য কম্বল, বালিশসহ খাবারের জন্য দেওয়া হয় থালা, বাটি ও মগ। সকালের নাস্তায় মাসের ১৮ দিন রুটি ও সবজি, ৯দিন খিচুড়ি এবং চারদিন রুটি ও হালুয়া খেতে দেওয়া হয়। দুপুর ও রাতের খাবারে নির্ধারিত পরিমাণে ভাত, মাছসহ মাসের ১০ দিন গরু, খাসি ও মুরগির মাংস দেওয়া হয় তাদের। এছাড়া জাতীয় দিবস ও উৎসবে পোলাও, মাংস, ডিম, পায়েস ও মিষ্টির ব্যবস্থা থাকে। তবে, কক্ষের চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। প্রতি বেলার খাবার তাদের সেলে পৌঁছে দেওয়া হয়। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে সেলের ছোট বারান্দায় হাঁটাহাঁটির সুযোগ রয়েছে।

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, ফাঁসির আসামিদের কোনো প্রশিক্ষণ বা কাজ করতে হয় না। কনডেম সেলে নারীদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে প্রার্থনা, পড়া, লুডু খেলা ও অন্য বন্দিদের সঙ্গে গল্প করে। যাদের বই, পত্রিকা পড়ার ঝোঁক রয়েছে, তাদের সেলেই তা সরবরাহ করা হয়। প্রতি মাসে একবার স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সপ্তাহে একবার মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পান তারা। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তারা সার্বক্ষণিক কারারক্ষিদের নজরদারি ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকেন।

তবে, একাধিক কারা কর্মকর্তা বলেন, বন্দি নারীদের অনেকেই বিষন্নতায় ভোগেন। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার অধীর আগ্রহে থাকেন। পারিবারিকভাবে অনেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কনডেম সেলে বন্দি নারীদের অনেকেই সন্তান বা পরিবারের জন্য কান্নাকাটি করেন। অনেককে কেউ দেখতে  আসে না। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া মানে আমাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়া। সেজন্য তাদের নানাভাবে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করা হয়।’

কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. শামীম ইকবাল বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি নারী আছেন কনডেম সেলগুলোতে। মৃত্যুদন্ডের মতো স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় তাদের সার্বক্ষণিক খোঁজ নেওয়া হয়। বিধি অনুযায়ী খাবারসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু দেওয়া হয়। যাদের আপিলের সামর্থ্য নেই তাদের জেল আপিলের ব্যবস্থা করা হয়।’

মায়ের সঙ্গে বড় হচ্ছে দুই শিশু : প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের দুটি কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে দুই নারীর সঙ্গে দুই শিশুসন্তান (সাড়ে চার ও এক বছর) রয়েছে। কারা কর্মকর্তারা বলেন, কারাগারে সাধারণ বা কনডেম সেলে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা তাদের মায়ের সঙ্গে থাকতে পারে। সেখানে কোনো প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডে কেয়ার সেন্টারগুলোতে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বর্ণমালা, ছড়া, কবিতার বই পড়াসহ খেলার সুযোগ মেলে তাদের। শিশুদের তিনবেলা পর্যায়ক্রমে খিচুড়ি, ডিম, কলা ও দুধসহ স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় পোশাক ও খেলনা দেওয়া হচ্ছে দুই শিশুকে।

হবিগঞ্জে একটি হত্যা মামলায় গত বছরের ২৬ অক্টোবর এক রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হুছনা আক্তার দুগ্ধপোষ্য কন্যাশিশুকে নিয়ে কনডেম সেলে যান। হুছনা তার এক বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে আছেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। এ  শিশুর বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসার পর গত ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট তার বিষয়ে জানতে চায়। একই সঙ্গে কনডেম সেলে মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নীতিমালা প্রণয়ন প্রশ্নে রুল দেয়। গত ২১ জানুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই শিশুকে প্রয়োজনীয় খাবার ও চিকিৎসাসহ সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

ফেনীর সোনাগাজীতে আলোচিত নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার আসামি কামরুন নাহার মণি ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কারাগারে থাকাকালে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। একই বছরের ২৪ অক্টোবর রায়ে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ হওয়ার পর ওই শিশুকে নিয়ে কনডেম সেলে যান। চার বছরের বেশি বয়সী ওই শিশুকে নিয়ে মণি আছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের কনডেম সেলে।

ওই কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, ‘সেলের পরিবেশ এখন অনেক উন্নত। তাদের বিষয়ে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকে। তাদের খেলা, পড়াসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করা হয়।’

মণির মা নূর নাহার মোবাইল ফোনে বলেন, মণির বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। মেয়ের সাজা হওয়ায় তারা সামাজিকভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ইতিমধ্যে জামাতা রাশেদ খান রাজু বিচ্ছেদের নোটিস দিয়েছেন। আর্থিকভাবে অসমর্থ ও দূর হওয়ায় বছরে দুই তিনবারের বেশি মেয়েকে দেখতে আসতে পারেন না। তবে, প্রতি সপ্তাহে মোবাইল ফোনে মেয়ে ও নাতনির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘মামলা চালাতে শেষ হয়ে গেছি। মেয়ে শুধু কান্নাকাটি করে। ওখান থেকে বাইরে আসতে চায়। নাতনিটা অনেক কিছুর আবদার করে। আমি বুঝ দিই মামলা শেষ হলে আসতে পারবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor