Trending

ম্যাজিক নেই আরও চাপে মানিব্যাগ

লাল ব্রিফকেস থেকে নতুন কোনো ম্যাজিক বের করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। গতানুগতিক অতি সাধারণ এক বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন তিনি। টাকার অঙ্কে যা ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি। অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জ সামনে দেয়া প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণের জন্য বড় কোনো সুখবর নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে দুঃসংবাদ। মূল্যস্ফীতির বাড়-বাড়ন্ত সময়ে এর লাগাম টানার সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় নানাভাবে বাড়লেও নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। বেড়েছে নানা খাতের করের হার। মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহারের মতো সার্বজনীন খাতে শুল্ক বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী সহজ পথ বেছে নিয়েছেন।

বহুদিন ধরে এমপিদের বিনা শুল্কে গাড়ি কেনার সুযোগ বাতিলেরও প্রস্তাব এসেছে বাজেটে, উপস্থাপনের সময়ই যার প্রতিবাদ করেছেন এমপিরা। নানা হিসাবনিকাশের এই বাজেটে বরাবরের মতোই বড় ঘাটতি রাখা হয়েছে। যার প্রায় পুরোটাই দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে পুষিয়ে নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে বছর বছর ঋণের বোঝা ভারী হওয়ায় প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণ শোধের বরাদ্দও রয়েছে শিক্ষাখাতের মোট বাজেটের সমান। টাকার অঙ্কে খাতওয়ারি বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও বিদ্যমান বাজারে চলতি বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ প্রায় একই বলে মনে করছেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারবে না। 

চলতি অর্থবছরের পুরোটা জুড়েই আলোচনায় ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর লাগাম টানতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এর কোনো হেরফের হয়নি। বরং বেড়েছে। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ২ ডজনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। 
এরমধ্যে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহে নতুন কৌশল নেয়া হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানো হচ্ছে। তবে শুধু মধ্যবিত্ত নয়, নিম্ন ও উচ্চবিত্তদের ওপরেও নানা ক্ষেত্রে বাড়ছে করের চাপ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোও এক ধরনের চাপ তৈরি করবে। সবমিলিয়ে সাধারণ মানুষের পকেটে নতুন করে চাপ তৈরি করবে প্রস্তাবিত বাজেট। 

সর্বশেষ দুই অঙ্কে ছুঁই ছুঁই মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বাজেটেও মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু বছর জুড়েই মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হয়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। 

উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন অর্থমন্ত্রী। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। লিখিত বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের গৃহীত এসব নীতি-কৌশলের ফলে আশা করছি, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা বলছে, অর্থমন্ত্রী উচ্চ মূল্যস্ফীতির যেসব কারণ দেখাচ্ছেন তা সমাধানে মোটা দাগের কোনো উদ্যোগ নেই বাজেট প্রস্তাবে। 

বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজস্ব আদায়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া লক্ষ্য পূরণ করতে শুল্ক বাড়ছে অনেক পণ্যে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের মুখে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ২০২২ সালে আইএমএফের ঋণের আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। ভর্তুকি কমানোসহ নানাবিধ শর্তে দেয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ১১৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার দুই কিস্তিতে পেয়েছে সরকার। এর আগে ও পরে বাংলাদেশ পরামর্শ অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোসহ আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে। ভর্তুকি সমন্বয়ের অংশ হিসেবে চলতি বছরের মার্চ থেকে বিদ্যুতের দাম খুচরায় ৮.৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ৫ শতাংশ দর বাড়িয়েছে সরকার। 

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৭৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা চাপের মুখে থাকলেও প্রাজ্ঞ ও সঠিক নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বছর বছরই এই লক্ষ্যমাত্রার প্রতি দ্বিমত করে আসছেন। অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কোনো লক্ষ্যই পূরণ হতে দেখা যায়নি।  

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। আগের মতোই বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বরং ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে নতুন একটি কর স্তর তৈরি করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এ কারণে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালে এটি নতুন একটি চাপ তৈরি করবে।   

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কিছু পণ্যের শুল্ক ও কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বেশকিছু পণ্য ও সেবায়। 
দেশি ফ্রিজ-এসি, সিগারেট, মোটরসাইকেল, বিদেশি পানির ফিল্টার, বৈদ্যুতিক বাতি, বিদেশি মাছ, পানীয়, ফলের রস, আইসক্রিম, মুঠোফোনে কথা বলা ও সিম, চিকিৎসা ব্যয়, বিনোদন সেবা, ইঞ্জিন অয়েল ও বাড়ি নির্মাণে ব্যবহৃত ইটের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। কোনো শিল্পের কাঁচামালই আর শূন্য শুল্কে আমদানি করা যাবে না। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশি সুইচ, সকেট, হোল্ডার ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে দেশে মানসম্মত সুইচ ও সকেট উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি সুইচ সকেটের ন্যূনতম আমদানি মূল্য প্রকৃত আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে কম। এতে স্থানীয় শিল্প অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সুইচ সকেটের যন্ত্রাংশ, সম্পূর্ণ সুইচ ও সম্পূর্ণ সকেটের ন্যূনতম মূল্য বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সুইচ, সকেট ও হোল্ডার ইত্যাদি উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। ৫ শতাংশ থেকে করা হয়েছে ১ শতাংশ। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী ল্যাপটপ, গুঁড়াদুধ, বিদেশি পোশাক, ডায়ালাইসিস সেবা, ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধের কাঁচামাল, শুকনা ফল, মাশরুম, চা, গ্রিন টি, কফি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুল্ককর ও শুল্কায়ন মূল্যে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে দাম কমার সুযোগ তৈরি হবে।

ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় আমানতকারীদের গচ্ছিত টাকায় আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। আবার ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এই দু’টি স্তরে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আয়-ব্যয়ের হিসাব: প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং করব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে, অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। 
ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

গতকাল বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। টানা চতুর্থ মেয়াদে গঠিত বর্তমান সরকারের এটি প্রথম ও টানা ১৬তম বাজেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২১তম বাজেট। 

বাজেট অধিবেশন শুরুর আগে, জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেন। সংসদে উপস্থাপনের জন্য নতুন অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেটে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন সম্মতিসূচক সই করেন। প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পরেই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন। পরে স্পিকারের অনুমতি সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d