Trending

‘যত বেশি প্রেসক্রিপশনের ছবি, তত বেশি লাভ’

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার মিজানুর রহমান শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কয়েকদিন আগে যান ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে এক মেডিসিনের চিকিৎসককে দেখানোর পর চেম্বার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ওষুধ কোম্পানির দুই-তিনজন তাকে ঘিরে ধরে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার চেষ্টা করেন।

তাতে বাঁধা দিলে সেখানে থাকা আরো চার-পাঁচজন ওষুধ কোম্পানির লোক এসে বাকবিতণ্ডায় জড়ান মিজানুরের সাথে। শেষ পর্যন্ত মিজানুর তাদেরকে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে যান।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র টেনে নিয়ে ছবি তোলার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সর্বশেষ শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএসএমএমইউ’তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। সেখানে মেডিসিন বিভাগের সামনে রোগীদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি।


ওই প্রকৌশলী তাদেরকে বাঁধা দিলে ওই রিপ্রেজেন্টিভরা আনিসুরের ওপর হামলা চালান। তাতে মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

আহত আনিসুর রহমান রোববার বলেন,‘সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর অনেক ধরনের টেস্ট করতে হয়। কিন্তু রিপ্রেজেন্টিভরা হাসপাতালের প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে জোর করে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তুলছিল। আমি বাঁধা দিতেই আমার ওপর হামলা চালিয়েছে তারা।’

রোগীদের হাত থেকে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ছবি তোলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না।

ছবি তুলতে বাঁধা দেয়ায় রোগীর ওপর হামলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আনিসুর রহমান বিএসএমএমইউ’র বহির্বিভাগ-১ এ হামলার শিকার হওয়ার পর ওই দিনই বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে হামলার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করেন।

যেখানে তিনি জানান, ১০-১২ জন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি তার ওপর যখন হামলা চালান তখন সেখানে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

আনিসুর বলেন,‘হামলার শিকার হওয়ার পর আমি ফ্লোরে পড়েছিলাম। গার্ড ও আনসাররা কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আমি বাধ্য হয়ে ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) এ পুলিশকে অভিযোগ জানাই। পরে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে।’

প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।

হামলায় আহত আনিসুর অভিযোগ করেন, হাসপাতালে যখন একজন রোগী যায় তখন তারা বিভিন্ন ধরনের পেরেশানির মধ্যে থাকে। তাদের সময় নষ্ট করে যখন জোর করে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা হয় তখন রোগীরা আরো বেশি হয়রানির শিকার হয় বলেই তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন।

বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন,‘এর আগে এ ধরনের ঘটনা কখনো আমাদের হাসপাতালে ঘটেনি। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা যে এতটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করবে আমরা সেটা বুঝতেই পারিনি।’

তিনি জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।

‘গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট’
শহর থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের একই চিত্র দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।

রাজধানীর মিরপুরের আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন,‘যখনই ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে যাই তখনই দেখি রিপ্রেজেন্টেটিভরা ডাক্তারের রুমের সামনে কক্ষগুলোর সামনে জটলা করে দাড়িয়ে থাকেন। রোগী বের হলেই প্রেসক্রিপশন হাত থেকে টেনে নেন ছবি তোলার জন্য।’

তিনি বলেন, তার কাছ থেকে কয়েকবার ছবি তোলার জন্য প্রেসক্রিপশন নিতে গেলে সেই সুযোগ তিনি দেননি।

বিএসএমএমইউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রিপ্রেজেন্টেটিভদের এসব কর্মকাণ্ড তাদের নজরে আসলে তারা এটি বন্ধ করতে বাঁধা দেন, কিন্তু তারপরও এটি বন্ধ হচ্ছে না।

বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ডা. রহমান বলেন,‘প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার ঘটনায় এখানে একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। আমরা সেই সিন্ডিকেটকে ফাইন্ড আউট করার চেষ্টা করছি। সিন্ডেকেট ভাঙ্গার চেষ্টা করছি।’

কিন্তু এটি নিয়ে নানা সমালোচনার পরও সেটি কেন বন্ধ হচ্ছে না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন করেছেন চিকিৎসকদেরও কেউ কেউ।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য একটা বিষয়। আজকাল সব কিছুতে অসৎ গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়েছে যে। এর কারণে সাধারণ রোগীদের হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে।’

রোগীদের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে ছবি তোলা যে একটা আপত্তিজনক কাজ সেটি মানছে রিপ্রেজেন্টেটিভদের সংগঠন বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টেটিভ এসোসিয়েশনও।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ অব প্রেসিডিয়াম মাসুদুর রহমান বলেন,‘এটাই আমাদের চাকরি। সেই চাকরি বাঁচাতে মান সম্মান নষ্ট করে আমাদের এই ঘৃণিত কাজটা করতে হচ্ছে।’

‘যত বেশি প্রেসক্রিপশনের ছবি, তত বেশি লাভ’
বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দায়িত্ব পালন করেন কয়েক লাখ কর্মী।
বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (ফারিয়া) বলছে, এসব কর্মীদের মধ্যে প্রায় তিন লাখ সদস্য রয়েছে তাদের সংগঠনে।

এই মেডিক্যাল প্রতিনিধিরা সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডাক্তারদের চেম্বারে দায়িত্ব পালন করেন। কখনো কখনো তারা ডাক্তারদেরকে তাদের কোম্পানির নতুন নতুন ওষুধ সম্পর্কে জানান, কখনো ছবি তোলেন ডাক্তারদের দেয়া রোগীদের প্রেসক্রিপশনের।

কিন্তু জোর করে, হাত থেকে প্রেসক্রিপশন টেনে কেন ছবি তুলতে ছুটে আসেন এসব মেডিক্যাল প্রতিনিধিরা?

জবাবে সংগঠনের চিফ অব প্রেসিডিয়াম মাসুদুর রহমান বলেন,‘আমরা ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সম্পর্কে ধারণা দেই। ডাক্তাররা সেগুলো লেখেন কী না সেটা আমাদের দেখে কোম্পানিকে জানাতে হয়, প্রথমত সে কারণে ছবি তুলতে হয়।’

এসব বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০টি প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার জন্য তাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে টার্গেট দেয়া হচ্ছে। সেই টার্গেট পূরণের জন্য তাদের কাজ করতে হয়। এটি করতে গিয়েই তারা অনেক সময় জোর করেই ছবি তুলে থাকেন।

কিন্তু এটি করতে গিয়ে সাম্প্রতিক রোগীদের সাথে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে। কখনো আবার এসব রিপ্রেজেন্টেটিভরাও হয়রানির শিকার কিংবা আটক হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

জবাবে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সংগঠনটি বলছে, এই ছবি তোলাকে পারফরমেন্সের অংশ হিসেবেই ধরা হয়।

চিফ অব প্রেসিডিয়াম মাসুদুর রহমান বলেন, যে যত প্রেসক্রিপশনের ছবি পাঠাতে পারে। তার ততো বেশি বোনাস, ইনক্রিমেন্ট কিংবা প্রমোশন হয়। সে কারণে এই পেশার সবার মধ্যে এক ধরনের ছবি তোলার প্রতিযোগিতা থাকে।

চিকিৎসক অধ্যাপক আজাদ বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর অসৎ প্রতিযোগিতা নতুন করে এই সংকট তৈরি করছে। এটা বন্ধ করতে রোগীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।

নিষেধাজ্ঞা কেন মানা হচ্ছে না?
চিকিৎসকরা বলছেন, ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন হল কোন রোগীর ব্যক্তিগত বিষয়। এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ও রয়েছে। এটাকে কারো কাছে প্রকাশ করা উচিত নয়। সুতারং এই ছবি নেয়া একটা আইন বিরুদ্ধ।

এটি বন্ধ করতে বিভিন্ন সময় সিভিল সার্জন কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও সেটি মানা হচ্ছে না।

পিজি হাসপাতালের প্রক্টর ডা. হাবিবুর রহমান বলেন,‘হাসপাতালে বসে ব্যবস্থাপত্রের যেন ছবি তোলা নয় হয় সেটি নিয়ে আমাদের হাসপাতালে আইন করা আছে। কিন্তু আইনটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।’

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার মাধ্যমে রোগীর অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর যোগসাজশ থাকার কারণে এই ছবি তোলা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ঢাকা মেডিক্যালর অধ্যাপক আজাদ বলেন, ‘প্রেসক্রিপশনের যে ছবি তোলা যাবে না, এই নিষেধাজ্ঞা যারা বাস্তবায়ন করবে তারা নিজেরাই তো অনেক সময় সিন্ডিকেট করছে। তাহলে কিভাবে আপনি এই কাজ বন্ধ করবেন?’

এক্ষেত্রে নতুন একটি পরামর্শ দিয়েছেন মেডিসিনের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, ‘যখন কোন প্রেসক্রিপশন লিখবেন, তখন ওষুধ কোম্পানির নাম না লিখে যদি ডাক্তাররা জেনেরিক নাম লিখেন তাহলে হয়তো বন্ধ করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে রোগীদেরও সহযোগিতা দরকার বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টেটিভস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, কোম্পানিগুলোর লাভের নেশায় এই সংকটে পড়তে হচ্ছে তাদেরও। এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারেরও কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করে সংগঠনটি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor