যার যার মতো ভবন দখল করে রেস্তোরাঁ
বেইলি রোডের আগুনের পর বন্ধ করে দেওয়া ধানমন্ডির সাতমসজিদের কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনটি তৈরি করেছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠান। জামায়াতে ইসলামীর এ নেতার মৃত্যুদণ্ডের পর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোর হস্তান্তর করা হয়। নকশা ভেঙে প্রবেশপথে বসানো হয় দোকান। নাম ভাঙানো হয় আওয়ামী লীগ নেতা, এমপিদের। রেস্টুরেন্টে ঠাসা ভবনটির ছাদ দখলে নেন মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি।
২০১২ সালের জুনে গ্রেপ্তার হন জামায়াতের আর্থিক শক্তির উৎস হিসেবে খ্যাত মীর কাসেম আলী। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর ফাঁসি হয়। এর সপ্তাহ দুই আগে ‘নিখোঁজ’ হন মীর কাসেমের বড় ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম। তিনি ব্যারিস্টার আরমান নামে পরিচিত। পরিবারের অভিযোগ, সরকারি সংস্থার পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক এসে তাঁকে মিরপুর ডিওএইচএসের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যান।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, মীর কাসেমের স্ত্রী এবং বাকি সন্তানরা বিদেশে রয়েছেন। কেয়ারি নাম রয়েছে– এমন অন্তত ২০টি কোম্পানিতে মালিকানা ছিল তাঁর। মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা দেশ ছাড়ার পর এগুলো বেদখল শুরু হয়। ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই এই দখলে যুক্ত।
ধানমন্ডির জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড মোড়ে পুরোনো ১৪৮জি নম্বর এবং নতুন ৬০ নম্বর প্লটে ২০০৭ সালে কেয়ারি ক্রিসেন্ট নামের ১২ তলা বাণিজ্যিক ভবনটি নির্মাণ করে মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠান কেয়ারি লিমিটেড।
৯ কাঠা ৪ ছটাক আয়তনের এই প্লটের মালিক ড. নাফিজ চৌধুরী এবং তাঁর দুই বোন। ভবনটিতে গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং পার্কিংয়ের জন্য দুটি বেজমেন্ট রয়েছে। নকশা অনুযায়ী, গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ ভবনটি ১৩ তলা হওয়ার কথা থাকলেও রয়েছে ১৪টি তলা। ওপরের এই তলাটি জমির মালিকদের। তবে এই তলাটি খালি পড়ে রয়েছে।
মালিকদের নিজেদের মধ্যে মামলা চলছে।
অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় গত সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে ভবনটি সিলগালা করে দেয়। সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে সেদিন জানান, ভবনের ছাদে স্থাপনা নির্মাণ চলছিল।
ভবনটিতে ব্যবসা করা কয়েকজন সমকালকে জানান, ছাদে রুফটপ রেস্টুরেন্ট নির্মাণের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পী ছাদ দখল নিয়ে নেতাকর্মী নিয়ে আড্ডা দিতেন। এ কারণে আর রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়া যায়নি। এখন অসমাপ্ত স্থাপনা পড়ে রয়েছে। তবে বারবার চেষ্টা করে রাজিবুল ইসলাম বাপ্পীর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
ভবনের নকশা অনুযায়ী, নিচতলায় (গ্রাউন্ড ফ্লোর) দুই পাশে দুটি দোকানের জায়গা রয়েছে। মাঝখানে চলাচলের জন্য সিঁড়ি থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত ২৪ ফুট ফাঁকা জায়গা রয়েছে নকশায়। কিন্তু এখানে ‘আফতাব রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড কাবাব’ নামে দোকান রয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এক যুবলীগ নেতা এই জায়গায় দোকানটি তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দখলে নেন ভবনটির মালিকদের আত্মীয় পরিচয় দেওয়া আরশাদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি মাসে দুই লাখ টাকা ভাড়া নেন দোকান থেকে। অভিযানে ভবনটি সিলগালা করে দেওয়ার পর থেকে আরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
আফতাব রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড কাবাবের পাশে ‘মিনি সো’ নামের আরেকটি দোকান রয়েছে। এই দোকানের মালিক শাহিন কবীর নামের এক ব্যক্তি। তিনি এই ভবনের ৩, ৬, ৭, ৯, ১১ তলা এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরে ২ হাজার ৩৮ বর্গফুটের মালিক। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাঁর কাছে এই সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়।
২০১৮ সালের ১৯ জুন নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও তাঁর মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি বা কোনো প্রকল্প হস্তান্তর না করা প্রসঙ্গে’ আদেশ জারি করা হয়। তার আগে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন কেয়ারি লিমিটেডের সেই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হুদা।
তিনি সমকালকে বলেছেন, ২০১৫ সালে তিনি কেয়ারি ছেড়েছেন। এরপর কী হয়েছে জানেন না, মনেও নেই। তাহলে ২০১৮ সালে কীভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করা হলো প্রশ্নে তিনি বলেছেন, এসব ক্রেতা আগেই টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তাদের কাছে সম্পদও আগে বিক্রি হয়েছে। পরে হস্তান্তর হয়েছে, যা স্বাভাবিক ঘটনা।
নিচতলায় বেজমেন্টে যাওয়ার পথের পাশে বুশরা কোল্ড কফি নামে একটি দোকান রয়েছে। এর মালিক মো. কালাম। তিনি ২৬ লাখ টাকায় নজরুল ইসলাম এবং ইকবাল হোসেন নামে দুই ব্যক্তির মধ্যস্থতায় দোকানটি কিনেছেন বলে কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবন সূত্র জানিয়েছে। তবে এর কাগজ পাওয়া যায়নি।
অভিযানের সময় ব্যবসায়ীরা দাবি করেছিলেন, শরীয়তপুর এবং ফরিদপুরের দুই এমপির মালিকানা রয়েছে ভবনটিতে। তবে পরে জানা যায়, এ দাবি সঠিক নয়। যারা ভবনটি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা এমপিদের নাম ভাঙাতেন।
নজরুল ইসলাম এবং ইকবাল হোসেন আগে কেয়ারির হয়ে ভবনটি দেখভাল করতেন বলে জানা গেছে। কেয়ারির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। চলাচলের পথ বিক্রি করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইকবাল হোসেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, কেয়ারিতে বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছি। বহু টাকা লোকসান হয়েছে। বিনিয়োগের কারণে এক সময় কেয়ারি ক্রিসেন্টে যাতায়াত ছিল। এখন আর যাই না।
কেয়ারি লিমিটেডে এক সময় চাকরি করতেন নকশা ভেঙে সিঁড়ির নিচে কেকের দোকান ভাড়া দেওয়া আজহারুল ইসলাম মিথুন। তিন তলায় একটি দোকান তাঁর দখলে রয়েছে। তবে একই দোকান আগে বিক্রি হয়েছিল দুবাইপ্রবাসী ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে। মিথুন তা কীভাবে কিনেছেন, তা স্পষ্ট নয়। বিনিয়োগকারী পরিচয় দেওয়া ইকবাল হোসেন সমকালকে বলেছেন, একমাত্র মিথুনের মালিকানা রয়েছে। তিনি কেয়ারিতে চাকরি করতেন। কীভাবে মালিক হয়েছেন, বলতে পারব না। শামসুল হুদা সমকালকে বলেছেন, এসব বিষয় মনে নেই।
এককালে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় শামসুল হুদা ২০২২ সালের ডিসেম্বরেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নাশকতার মামলায়। একটি সূত্রের ভাষ্য, তিনি রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকায় ভবন নির্মাতার অংশ নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। মীর কাসেম আলীর উত্তরাধিকারী না আসায় অনেকগুলো পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে যে যার মতো লিখে নিয়েছে। জমির মূল মালিক নাফিজ চৌধুরী না আসায় এবং মামলার কারণে আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা যেমন ইচ্ছা নকশা পরিবর্তন করে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দিয়েছেন। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো আর দেখা হয়নি। এখন এর খেসারত দিচ্ছেন ভাড়া নিয়ে রেস্টুরেন্ট করা ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে পরের বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মীর কাসেমের তিনটি ফ্ল্যাট ও ১১টি দোকান হস্তান্তর করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মীর কাসেম আলী ও তাঁর মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর এবং দলিল রেজিস্ট্রেশন না করতে নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠির অনুলিপি আইনমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ২২ ও ২৩ এপ্রিল কেয়ারি লিমিটেডের কিছু সম্পত্তি উত্তরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য উপস্থাপিত হয়। বিষয়টি জানার পর আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তা জানানো হয়। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে বিরত থাকতে সাব-রেজিস্ট্রারদের নির্দেশ দিতে বলেন। পরে আইনমন্ত্রীকেও জানানো হয়। মন্ত্রীও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রি না করার নির্দেশ দেন।
তবে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর তৎকালীন উপসচিব এস এম নজরুল ইসলাম কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনের ১২ তলায় ১ হাজার ৮৪ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট খন্দকার হাবিবার নামে হস্তান্তরের আদেশ জারি করেন। পরের বছরের ২৯ জানুয়ারি তা হস্তান্তর করা হয়।
এসব বিষয়ে মীর কাসেমের পরিবারের কারও বক্তব্য জানতে পারেনি।