Science & Tech

যুক্তরাষ্ট্রের ‘এআই ঘোড়ার’ লাগাম টেনে ধরল চীনের ডিপসিক

বিশ্ব প্রযুক্তিখাত ও এআই জগতে হুট করেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে চীনের স্বল্পপরিচিত নতুন স্টার্ট-আপ ডিপসিক। এক সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপ হয়ে উঠেছে এটি। ফলে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এআই খাতের আধিপত্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। প্রযুক্তি জায়ান্টদের বাজারমূল্যে সৃষ্টি হয়েছে ভূমিধস পরিস্থিতি। এছাড়াও মাত্র একদিনের ব্যবধানে বিশ্বের অন্যতম চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। তাদের শেয়ারমূল্য কমে গেছে ১৭ শতাংশ। এ ধস এখন কোথায় গিয়ে থামে সেটি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে প্রযুক্তিপাড়ায়।

সম্প্রতি ডিপসিকের নতুন সংস্করণ ডিপসিক-আর১ প্রকাশের পর প্রযুক্তি দুনিয়ায় যে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার নজর এড়ায়নি নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।

এক বিবৃতিতে ডিপসিকের উদ্ভাবনকে তিনি ‘জেগে ওঠার অ্যালার্ম’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি এআই খাতে প্রতিযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতকে আরও কার্যকর হওয়ার আহ্বান জানান।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, চীনা এই এআই বট মার্কিন অর্থনীতির জন্য বিপদ ঘণ্টা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধরাই যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এআই ঘোড়ার’ লাগাম টেনে ধরেছে চীনের ডিপসিক।

ডিপসিক-আর১ এর নির্মাতা লিয়াং ওয়েনফেং দাবি করেছেন, তাদের এ মডেল উন্নত বিশ্বের চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কম সংখ্যক কম্পিউটার চিপ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এতে খরচও হয়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নামমাত্র মূল্যে।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মডেল তৈরিতে ডিপসিক মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপেনএআই এবং গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলিয়ন ডলারের এআই বাজেটের তুলনায় অনেক কম।

দ্য কোবেইসি লেটারের প্রতিষ্ঠাতা ও বাজার বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কোবেইসি এক্স-এ এক স্ট্যাটাসে বলেন, ওপেনএআই যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় ১০ বছর আগে। সে সময় তাদের সাড়ে ৪ হাজার কর্মী ছিল। তারা ফান্ডিং তুলেছিল প্রায় ৬৬০ কোটি টাকার। আর ডিপসেক যাত্রা করেছে মাত্র ২ বছর আগে। তাদের কর্মী ২০০ এরও কম।

ডিপসিক চীনের হাংঝৌতে ২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং। যিনি একজন অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা এবং হাই-ফ্লাইয়ার নামক হেজ ফান্ড পরিচালনা করেন। চীনের বাইরে কম পরিচিত হলেও লিয়াং প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ খাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তবে তাকে বিশ্ব পরিসরে সেভাবে কেউ চিনতো না। কেন তিনি এই জগতে প্রবেশ করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে শুধু কৌতূহলের বশে পা রেখেছেন তিনি।

গত মাসে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তাদের ডিপসিক-ভি৩ মডেলের প্রশিক্ষণে এনভিডিয়ার এইচ ৮০০ চিপ ব্যবহার করে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে।

ডিপসিক এটিও প্রমাণ করে দেখিয়েছে, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এআই মডেল তৈরিতে বিশাল বিনিয়োগ কিংবা সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি সবসময় প্রয়োজন হয় না। ডিপসিকের সাফল্য দেখিয়েছে, সঠিক কৌশল এবং বিশেষায়িত মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে কম শক্তির চিপও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা সম্ভব।

ডিপসিকের উত্থান কিছু দেশে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তি মন্ত্রী এড হুসিক এটি নিয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন- মান, গ্রাহক পছন্দ, ডেটা ও গোপনীয়তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সময়ের সঙ্গে সমাধান করতে হবে।

এদিকে ওপেনএআই সিইও স্যাম অল্টম্যান ডিপসিকের প্রযুক্তিকে প্রভাবশালী মডেল হিসেবে প্রশংসা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, ওপেনএআই ভবিষ্যতে আরও উন্নত মডেল সরবরাহ করবে। ডিপসিকের মতো এমন ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকা ভালো। তবে এটি নিয়ে ওপেনএআই এখনও চিন্তিত নয়। শিগগিরই আরও উন্নত মডেল বাজারে আনার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।

সিলিকন ভ্যালির অন্যতম প্রভাবশালী ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মার্ক আন্দ্রেসেন রোববার এক্স-এ এক পোস্টে বলেন, ডিপসিক-আর১ হচ্ছে এআই-এর স্পুটনিক মুহূর্ত। এই মন্তব্যটি স্পুটনিক স্যাটেলাইটের ইঙ্গিত দেয়, যা একসময় মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। মহাকাশ জয়ের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। সবার আগে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রই শেষ কথা নয়। ডিপসিক সবার আগে আসেনি তবে কদিনেই এটি চ্যাটজিপিটিকে পেছনে অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে শীর্ষে উঠে গেছে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাত কীভাবে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে।

ডিপসিকের এ অগ্রগতি এআই খাতে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করবে এবং এআই প্রযুক্তি উন্নয়নের ভবিষ্যৎ গতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মত দিয়েছেন প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে এর ব্যবহারকারী পর্যন্ত।

বড় বড় কক্ষে রাখা এক সময়ের বিশাল বিশাল কম্পিউটার যেমন এখন প্রযুক্তির কল্যাণে সবার হাতে হাতে, ঘরে ঘরে তেমনি সময়ের ব্যবধানেও একেক প্রতিষ্ঠানের এআই প্রযুক্তি দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে। নতুন একটি এসে পুরোনোটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন ছুঁড়ছে- প্রযুক্তি দুনিয়ায় সবচেয়ে আপডেট বলে কিছুই নেই, সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে জিতে যাওয়া কেবল কিছু সময়ের ব্যাপার। নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠান ঠিকই বর্তমানে সেরা অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে গিয়ে যাবে।

প্রযুক্তি দুনিয়ার এই দুর্দমনীয় প্রতিযোগিতা কোথাও গিয়ে থামবে বলে মনে হয় না। তবে এই বিপ্লব যেন ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী রূপে রূপান্তরিত না হয়ে বিশ্বকে সামগ্রিক উন্নয়নে এগিয়ে নিয়ে যায় সেটিই প্রত্যাশা প্রযুক্তিবিদদের।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button