USA

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে টেইলর সুইফট ইফেক্ট

মহাতারকা টেইলর সুইফট কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন। তার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কি প্রভাব ফেলবে? লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ‘টেইলর সুইফট’ একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। বিপুল জনপ্রিয় এ শিল্পী যাকে ভোট দেবেন, ভক্তরা স্বাভাবিকভাবে তাকে ভোট দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টেইলর সুইফট কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। তার এ ঘোষণার পর আলোচনা শুরু হয়েছে ‘সুইফট ইফেক্ট’ নিয়ে। দ্য গার্ডিয়ানে লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক রিচার্ড টি লনগোরিয়া লিখেছেন, কমলা হ্যারিসকে টেইলর সুইফটের সাম্প্রতিক সমর্থন কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে? এটা অবশ্যই হতে পারে। আমি বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকান রাজনীতিতে সেলিব্রিটিদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে আসছি। গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ আমেরিকান ভোটারদের জন্য একটি সেলিব্রিটির অবস্থান কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা কাকে ভোট দেবে, সে বিষয়ে স্থির এবং খুব কম আমেরিকান এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ইউগভের সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রায় ৫ শতাংশ আমেরিকান ট্রাম্প না কমলা কাকে ভোট দেবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন। যাই হোক, এই পাঁচ শতাংশ জয় এবং হারের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হতে পারে। একই ইউগভ জরিপ দেখাচ্ছে, ট্রাম্প এবং কমলা প্রত্যেকে ৪৫ শতাংশ ভোট পাবেন। তিনি আরও বলছেন, আমার গবেষণা এ পরামর্শ দেয় যে, প্রায় ১১ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক তারকাদের দ্বারা প্ররোচিত হতে পারে এবং প্রায় ১৯ শতাংশ তরুণও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। অনিয়মিত বা নতুন ভোটারদের মধ্যে একজন তারকাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। যে লোকরা নতুন করে রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী বা যারা সাধারণত তারকাদের নিয়ে গসিপের মতো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের জন্য সুইফটের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এ মুহূর্তে ট্রাম্প এবং কমলা উভয়ই সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন, একই সঙ্গে তাদের মূল সমর্থকদের উৎসাহিত করছেন।

এ লেখকের মত এ ক্ষেত্রে সুইফটের সমর্থন পেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছেন কমলা।

তারকা প্রভাব

লনগোরিয়া লিখেছেন, ট্রাম্প এবং কমলা তাদের প্রচারণায় কয়েক মাস ধরে অনেক তারকার সমর্থন পেয়েছেন। কমলা হ্যারিসকে জেফ ব্রিজস, চের, জেমি লি কার্টিস, ভায়োলা ডেভিস, মার্ক হ্যামিল, স্পাইক লি, জন লিজেন্ড, ডেমি লোভাটো, মেগান থি স্ট্যালিয়ন, অ্যামি শুমার, বারব্রা স্ট্রিস্যান্ড, কেরি ওয়াশিংটন ও ব্র্যাডলি হুইটফোর্ড সমর্থন দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন জেসন অ্যাল্ডিয়ান, রোজেন বার, হাল্ক হোগান, কিড রক, অ্যাম্বার রোজ ও জন ভয়ট। সুইফট যদি হ্যারিসের সমাবেশে উপস্থিত হতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি জনতার মধ্যে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বইয়ে দিতেন এবং এটি একটি বড় গল্প হয়ে উঠত। প্রার্থী ও ইস্যুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারকারা রাজনীতিবিদদের নতুন করে জনগণের সামনে তুলে আনতে পারেন। এ লেখক আবার বলছেন, তারকাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার। বেশিরভাগ আমেরিকান বলে যে, তারা এমন তারকার অনুরাগী হওয়ার সম্ভাবনা কম, যে তাদের পছন্দ না এমন রাজনীতিবিদকে সমর্থন করেন। বাস্কেটবল তারকা মাইকেল জর্দান উত্তর ক্যারোলিনায় কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করার পর বলেছিলেন, ‘রিপাবলিকানরাও জুতা কেনেন’। তিনি আসলে অর্থনৈতিক দিকটি তুলে আনতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন রিপাবলিকানদেরও টাকা আছে।

তবে লনগোরিয়া বলছেন, টাকাই শেষ কথা নয়। তিনি লিখেছেন, কিন্তু কিছু জিনিস টাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারকারাও মানুষ। তাদের মতামত আছে, তারা নিজেদের আলাদা করতে চান অন্যদের চেয়ে। তাদের একটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা লাখ লাখা ভক্তের কাছে তারা যা বলতে চান, সেটা পৌঁছে দেন। কিছু গবেষণা পরামর্শ দিয়েছে যে, বারাক ওবামা ২০০৮ সালে অপরাহ উইনফ্রের সমর্থনের কারণে অতিরিক্ত ১ মিলিয়ন ভোট পেয়েছিলেন। উইনফ্রে ও সুইফট উভয়েরই প্রচুর ফলোয়ার রয়েছে এবং যদি তাদের একটি সামান্য শতাংশও এক প্রার্থীকে অন্য প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে রাখতে পারে। শেষে তিনি লিখেছেন, নিঃসন্দেহে আমেরিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ বছরের নির্বাচনে ‘সুইফট ইফেক্ট’ পরিমাপ করার চতুর উপায় নিয়ে ভাবছেন।

ইউরো নিউজ জানাচ্ছে, যদিও সেলিব্রিটিদের সমর্থন সাধারণত প্রচারাভিযানে বিশাল প্রভাব ফেলে না। তবে সুইফট কোনো সাধারণ সেলিব্রিটি নন এবং তার বিবৃতিটি প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সুইফটের বিশাল ফ্যান রয়েছে, তার ২৮৩ মিলিয়ন ফলোয়ার রয়েছে এবং ১ মিলিয়নেরও বেশি লোক ইতিমধ্যেই কমলাকে সমর্থন জানিয়ে ইনস্টাগ্রামের দেওয়া তার পোস্ট পছন্দ করেছে। টেইলর যখন কথা বলেন, তার ভক্তরা শোনেন এবং একটি একক মিডিয়া পোস্ট প্রমাণ করে যে, তিনি কীভাবে রাজনীতির জগতেও প্রভাব ফেলতে পারেন। পপ সুপারস্টার খুব ভালোভাবে তরুণ ভোটারদের উৎসাহ বাড়িয়ে তুলতে পারেন এবং তার অতীতের বিবৃতি হাজার হাজার লোককে ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন খুলতে পরিচালিত করেছে।

নিঃসন্তান বিড়ালমানবী

টেইলর সুইফটকে নিয়ে এত আলোচনার শুরুটা ইনস্টাগ্রামে করা তার মতামত নিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, আপনাদের অনেকের মতো, আমিও আজ রাতে বিতর্ক দেখেছি। এখন আপনার হাতে থাকা ইস্যু এবং প্রার্থীরা আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কোন অবস্থান নিয়েছেন, তা নিয়ে গবেষণা করার একটি দুর্দান্ত সময়। একজন ভোটার হিসেবে এই দেশের জন্য তাদের প্রস্তাবিত নীতি ও পরিকল্পনা কী তা দেখতে এবং পড়তে পারি আমি।

সুইফট লিখেছেন, সম্প্রতি আমি দেখেছি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি আমার একটি ছবি ব্যবহার করে বলা হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমি সমর্থন করি, যা তার সাইটে পোস্ট করা হয়েছিল। এটি সত্যি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর বিপদকে জাগিয়ে তুলেছে। এটি আমাকে এই উপসংহারে এনেছে যে, একজন ভোটার হিসেবে এই নির্বাচনের জন্য আমার প্রকৃত পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাকে খুব স্বচ্ছ হতে হবে। ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সহজ উপায় হলো সত্যের সঙ্গে থাকা। আমি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিস এবং টিম ওয়ালজের জন্য আমার ভোট দেব। আমি কমলা হ্যারিকে ভোট দিচ্ছি, কারণ সে অধিকারের জন্য লড়াই করে এবং কারণ আমি বিশ্বাস করি, তাদের চ্যাম্পিয়ন করার জন্য একজন যোদ্ধার প্রয়োজন। আমি মনে করি তিনি একজন অবিচলিত, প্রতিভাধর নেতা এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমরা যদি বিশৃঙ্খলা না করে শান্ত হয়ে থাকি, তবে আমরা এ দেশে আরও অনেক কিছু অর্জন করতে পারি। আমি তার রানিং সাথি টিম ওয়ালজকে নির্বাচন করে খুবই আনন্দিত এবং প্রভাবিত হয়েছি, যিনি কয়েক দশক ধরে এলজিবিটিকিউ অধিকার, আইভিএফ এবং একজন নারীর শরীরের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আমি আমার গবেষণা করেছি এবং আমি আমার পছন্দ নির্ধারণ করেছি। তবে আপনার গবেষণা আপনার এবং পছন্দ আপনার। আমি আরও বলতে চাই, বিশেষ করে প্রথমবারের ভোটারদের উদ্দেশে; মনে রাখবেন যে ভোট দিতে হলে আপনাকে নিবন্ধিত হতে হবে! আমিও মনে করি আগে ভোট দেওয়া সুবিধাজনক। আমি কোথায় নিবন্ধন করতে হবে তা খুঁজব এবং আমার প্রাথমিক ভোটের তারিখ এবং তথ্য খুঁজে বের করব। ভালোবাসা এবং আশা নিয়ে, টেইলর সুইফট, নিঃসন্তান বিড়ালমানবী।

রাজনীতিতে সুইফট

ওয়্যারড ডটকম জানাচ্ছে, টেইলর সুইফট ভালোই জানেন, কীভাবে ভক্তদের মধ্যে কোনো মতাদর্শের বীজ বপন করতে হবে। তার গানগুলো শ্রোতাদের বোধগম্য করে লেখা হয়েছে। সুইফট নামটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। এজন্য দ্য স্টেট অব ইসরায়েল প্রায় সময় বিভিন্ন পোস্টে তাকে ট্যাগ করে এবং তার ফিলিস্তিনি ভক্তরা তাকে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেন। সেলিব্রিটিরা রাজনৈতিক আন্দোলন দ্বারা যুগ যুগ ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছেন। রাজনীতিবিদরাও সেলিব্রিটি। সুইফট ভক্তরা যুগপৎভাবে রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রিটি উভয় ধরনের জনপ্রিয়তাকে পছন্দ করেন। যদিও তারা একটু ব্যতিক্রম। জীবনের প্রথম দিককার অর্ধেকেরও বেশি সময় সুইফট অরাজনৈতিক ছিলেন। ফলে তার ভক্তরা তখন তাকে নিয়ে নিজেদের মনমতো ব্যাখ্যা তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু পরিশেষে তিনি নারী অধিকার, সমকামী অধিকার ও কয়েক বছর ধরে জো বাইডেনের সমর্থনে মাঠে নামলে তার কিছু ভক্ত বিচ্ছিন্ন এবং কিছু ভক্ত নীরব হয়ে পড়ে।

দ্য কনভারসেশন ডটকম বলছে, তার বিবৃতিতে সুইফট ব্যাখ্যা করেছেন কেন তিনি কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করবেন, তিনি সরাসরি কাউকে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিতে বলেননি। পরিবর্তে তিনি লোকদের তাদের গবেষণা করতে এবং ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে উৎসাহিত করেছেন। সুইফটের পোস্টের একটি আকর্ষণীয় অংশ হলো ওয়ালজ এবং তার নীতির সুস্পষ্ট উল্লেখ। ওয়ালজ হ্যারিসের প্রচারে এক ধরনের অভিভাবকসুলভ বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তিনি নিয়মিত প্রতিবেশীদের যত্ন নেওয়ার এবং আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে ভালোবাসতে স্বাধীন হওয়ার বিষয়ে গল্প বলেন। ট্রাম্পের হুমকি-ধমকির বিপরীতে যা বেমানান। এ জায়গাটিও সুইফট কৌশলে বুঝাতে চেয়েছেন। ফলে তার ইনস্টাগ্রাম পোস্ট অন্য তারকাদের মতো কম তাৎপর্যের নয়। বরং সুইফট যে আসন্ন নির্বাচনে একটি ‘ইফেক্ট’ হয়ে উঠেছেন, সেটা তার নিজ গুণেই। শুধু তার গান নয়, তার রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ কর্মকাণ্ডও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, যা সামনে আরও স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button