যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক চুক্তি, জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার তিক্ততা কি মিটবে
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তিকে নিবিড় সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অবকাশ কেন্দ্র মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ক্যাম্প ডেভিডে তিন দেশের শীর্ষ নেতারা এই চুক্তি করেন। বলা হচ্ছে, তিন দেশেরই প্রতিপক্ষ এশীয় পরাশক্তি চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ বৈরিতা সত্ত্বেও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম এই ধরনের চুক্তিতে অংশ নিল। ক্যাম্প ডেভিডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল ঐতিহাসিক এই ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের হিসাব-নিকাশ থেকেই শুধু ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এই চুক্তির তাৎপর্যের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়েই ওয়াশিংটনের মিত্র হলেও তাদের নিজেদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। জাপান অতীতে একসময় ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর। সেই অতীতের তিক্ততাপূর্ণ স্মৃতি আছে সিউলের।
এ কারণে দুই শক্তির এই অভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এই দুই শক্তির বন্ধুত্ব প্রয়োজন। কারণ দুটি দেশে ৮৪ হাজার ৫০০ জনের মতো মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। দীর্ঘ অতীতের প্রেক্ষাপটে পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ আদৌ তিক্ততা ভুলতে পারবে কি না—বিশ্লেষকরা এ প্রশ্ন না তুলে পারছেন না।
বৈঠক শুরুর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুই শীর্ষ নেতার ‘রাজনৈতিক সাহসিকতার’ প্রশংসা করেন। পরে প্রকাশিত চুক্তির যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, তিন দেশ পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের বিবদমান সমুদ্র অঞ্চলে ‘চীনের বিপজ্জনক ও আগ্রাসী আচরণের’ বিরোধী।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এসকে-কোরিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ার অ্যান্ড্রু ইয়েও বলেন, ‘এই চুক্তি ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা গত তিন দশক ধরেই ভঙ্গুর।’
তবে অ্যান্ড্রু ইয়েও এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপনিবেশিক অতীতের ক্ষত রাতারাতি দূর হবে না।
কূটনৈতিক উত্তেজনাও অব্যাহত থাকবে। যেমন : তিন সপ্তাহ আগে জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাকেশিমা দ্বীপকে নিজেদের দাবি করলে সিউল ও টোকিওর মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু ইয়েও এ-ও বলেন, কিশিদা কিংবা সুক-ইওন উভয়ের প্রতিই স্বদেশে জনসমর্থন তুলনামূলকভাবে কম থাকায় দেশে ফিরে এ থেকে হয়তো সীমিত কূটনৈতিক লাভই পাবেন।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, তিন দেশ নিয়মিতভাবে মহড়া আয়োজন করবে, সংকটকালে হটলাইনের মাধ্যমে মতবিনিময় করবে, কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলায় তথ্য ভাগাভাগি করবে এবং নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস উইল্ডার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের প্রশাসনের অধীনে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি জানান, ওই সময় দুই দেশের নেতৃত্বকে এমনকি এক কক্ষে বৈঠক করাতেও পাশাপাশি বসানো যেত না।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বৈরিতার কারণ
বিংশ শতাব্দীতে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান তখনকার যুদ্ধবাজ জাপান প্রতিবেশী কোরিয়াকে জোর করে উপনিবেশে পরিণত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের অপহরণ করা এবং যৌনদাসী হিসেবে রাখার অভিযোগ রয়েছে জাপানি সেনাদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে এখনো বেশ ক্ষোভ রয়েছে। সিউলের অভিযোগ, জাপানি কর্তৃপক্ষ কখনো ঔপনিবেশিক সময়ের নিষ্পেষণের জন্য ক্ষমা চায়নি।
জাপানি বাহিনী কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করার ঘটনায় ২০১৮ সালে সিউলের আদালতে একটি মামলা হয়। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে ব্যাপক তিক্ততা সৃষ্টি হয়।
অতীতের সেই তিক্ততার স্মৃতি পেছনে ঠেলে অগ্রসর হতে চাইছেন দুই দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টরা।