যুক্তরাষ্ট্রের ভোটে উদ্বেগের চোখ ইউরোপের
আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দোরগোড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও তার প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ সময়েও ভোটারদের কাছে টানতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশটির ভোটাররাও নির্বাচনে তাদের মতামত প্রদান করতে প্রস্তুত। এবার দেখার অপেক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউজে যাবেন, নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ইউরোপ ও পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাই এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হন তা দেখার অপেক্ষায় আছে।
এই নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর ভাবনা মহাদেশীয় নিরাপত্তা ও ইউক্রেইন যুদ্ধে তার কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপের একাধিক দেশ। সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ইউক্রেন পরিস্থিতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে ২০ জনেরও বেশি ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে।
ইউক্রেন এবং ইউরোপের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে অনেক ইউরোপীয় কর্মকর্তাই বলেছেন, তারা রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ট্রাম্পের প্রথম ক্ষমতাকালীন সময়ে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক টালমাটাল থাকার বিষয়টিকে এর পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি দোদুল্যমান থাকায় ইউরোপে নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা জানিয়েছেন ইউরোপীয় কর্মকর্তারা। তবে তাদের সবারই মন্তব্যে মূল যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিত্বের মানুষ নিয়ে, যার সম্পর্কে আগে থেকে কিছু আঁচ করা যায় না। ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্সান্ডার স্টাব বলেছেন, আমরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই নির্বাচনের একটা প্রভাব আছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হলেও চলতি মাসে ট্রাম্প যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে দায়ী করেছেন। আসন্ন নির্বাচনে জিতলে একদিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে তিনি কীভাবে সেটি করবেন তা বলেননি। আবার ইউক্রেনকে সাহায্য করতে চান না এমন কথাও ট্রাম্প বলেননি। যার ফলে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন যুদ্ধের কোনওরকম অবসান হলে সেটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জয় হিসাবেই পরিগণিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে অনেকবারই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প। ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে তিনি মস্কোকে ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোকে আক্রমণ করতে উৎসাহ দিতে পারেন বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে জোটভূক্ত দেশগুলো। যদিও পুতিন বরাবরই নেটো দেশগুলোতে হামলা চালানোর কোনওরকম অভিপ্রায় থাকার কথা অস্বীকার করে আসছেন।
অন্যদিকে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জয়ী হলে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার নীতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। সম্প্রতি রাশিয়ার হয়ে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে কোন সীমা রাখা হবে না বলে জানিয়েছে। আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তীব্র সমালোচক কমলা হ্যারিস। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জিতলে যুদ্ধে ইউক্রেইনের হাতই শক্তিশালী রাখা এবং ন্যায়সঙ্গত শান্তি অর্জন নিশ্চিত করার জন্য তিনি কাজ করবেন। তবে তিনিও ইউক্রেন নিয়ে বিস্তারিত কোনও পরিকল্পনা এখনো জানাননি।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ইউক্রেন ও দেশটির ইউরোপীয় সমর্থকরা একটি কঠিন সময় পার করছে। মস্কোর সেনাবাহিনী পূর্ব ইউক্রেইনে লড়াইয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রুশ হামলায় ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় আসন্ন শীত মৌসুমে কিয়েভকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আবার ইউরোপের দেশগুলোতেও অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি মহাদেশজুড়ে সরকারি আর্থিক খাতের অবস্থা টনটান। রাশিয়া-বান্ধব জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সম্প্রতি কয়েকমাসে অস্ট্রিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভাল ফল করেছে।
নেটো জোটের একটি দেশের এক কূটনীতিক বলেছেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে ততই ইউক্রেইনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোরভাবে কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে হঠাৎ কোনও পরিবর্তন আসলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। তেমনটা হলে ইউরোপে রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদের মুনাফা কাজে লাগাতে পারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। গত জুনে রাশিয়ার জব্দ করা আর্থিক সম্পদ থেকে যে আয় হচ্ছে তা থেকে ইউক্রেনকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭। গত সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বোঝাপড়া হয়েছে। এই চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে ইউক্রেইনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও ইউক্রেইন এই অর্থ দিয়ে অস্ত্র কিনতে পারবে। পশ্চিমা এক কর্মকর্তা বলেছেন, জি-৭ এর এই ৫ হাজার কোটি ডলার ইউক্রেইনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কেবল এটিই নয়, এর পাশাপাশি ইউক্রেইনকে সমন্বিতভাবে সহায়তা দেওয়ার জন্য ন্যাটো জোট একটি কমান্ডও প্রতিষ্ঠা করছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিশেষ কোয়ালিশনের কাছ থেকে বেশির ভাগ কাজের দায়িত্বই নিয়ে নিয়েছে তারা। তবে ন্যাটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থাকায় এ চেষ্টা কতটা কাজে আসবে তা নিয়েও সংশয় আছে।
যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, ন্যাটোর কাঠামোর আওতায় তাদের এই প্রচেষ্টা হঠাৎ কোনও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলেও ন্যাটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থাকায় এ চেষ্টা কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে সংশয় আছে। এসব শঙ্কার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদেরকে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, পুতিন জয় পেলে তা যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল প্রতিপন্ন করবে এবং আমেরিকার শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে রাশিয়া এবং চীনকে উৎসাহী করে তুলবে।