যুক্তরাষ্ট্রে কি রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্রে গত বুধবার প্রতিনিধি পরিষদে যে মুহূর্তটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্র চার্লি কার্ককে নিয়ে নীরবতা পালন হওয়ার কথা, তখন সেখানে চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। এ ঘটনায় দেশটির রাজনৈতিক বৈরিতা এবং বিভাজন তিক্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
গত বুধবার ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে কার্ক নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিধি পরিষদের আইনপ্রণেতারা তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর সঠিক উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এ সময় কলোরাডোর রিপাবলিকান প্রতিনিধি লরেন বোবার্ট হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং কাউকে দিয়ে প্রার্থনা করানোর প্রস্তাব দেন।
এ সময় প্রতিনিধি পরিষদে কয়েকজন ডেমোক্র্যাট সদস্য প্রশ্ন তোলেন, কেন কম পরিচিত মানুষদের হত্যার ঘটনাগুলোকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এমন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রতিনিধি পরিষদে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগও ওঠে। গত বুধবার প্রতিনিধি পরিষদে উপস্থিত ছিলেন এমন এক আইনপ্রণেতা রয়টার্সকে এসব তথ্য দিয়েছেন।
প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। আর ওই সময় এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘একটা আগ্নেয়াস্ত্র আইন পাস করুন।’
৩১ বছর বয়সী কার্ক রক্ষণশীল সংগঠন টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোর সমর্থক ছিলেন। গত বুধবার ইউটাহর ওরেম শহরে ইউটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী, তা জানা যায়নি। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুক্রবার জানিয়েছেন। তবে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয়নি।
দুই বছর আগে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে কংগ্রেস। ৩০ বছরের মধ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ এটাই প্রথম। তবে দুই দলের সমর্থনে পাস হওয়া বিলটি আইনি ফাঁকফোকর এবং যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারলেও, গুলির ঘটনা তেমন একটা থামাতে পারেনি।
কার্ককে হত্যার ঘটনায় তাঁর অনেক রক্ষণশীল সহকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এ হামলার জন্য উদারপন্থী রাজনীতিকদের দায়ী করেছেন। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে কঠোর আগ্নেয়াস্ত্র আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছেন।
এ ধরনের তর্কবিতর্ক মার্কিন আইনপ্রণেতাদের কাছে পরিচিত ঘটনা। ব্যক্তিগতভাবেও এর প্রভাব রয়েছে।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের দ্বিতীয় শীর্ষ রিপাবলিকান সদস্য স্টিভ স্ক্যালিস বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এর শেষ হতে হবে।’
বুধবার স্টিভ আরও বলেন, ‘এটা এমন একটা সমস্যা, যা আমরা বৃদ্ধি পেতে দেখছি। এটা মোকাবিলা করতে হবে। বন্ধ করতে হবে।’
স্ক্যালিস নিজেও ২০১৭ সালে কংগ্রেসীয় বেসবল অনুশীলন চলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুথ ব্রাউনস্টাইন কার্ক ও ডানপন্থী রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় আগে থেকে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় ৪৬ হাজার ৭২৮ জন নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা এ যাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
দুই বছর আগে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে কংগ্রেস। ৩০ বছরের মধ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ এটাই প্রথম। তবে দুই দলের সমর্থনে পাস হওয়া বিলটি আইনি ফাঁকফোকর এবং যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারলেও গুলির ঘটনা তেমন একটা থামাতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিভাজন
কার্কের মৃত্যুর ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলাকে কেন্দ্র করে দেশটির মানুষ কোনো ট্র্যাজেডি নিয়ে এক জোট হয়েছিল।
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম সেরা সমর্থককে হারিয়েছে। এখন আমাদের সবার দায়িত্ব হলো, সেই দুষ্টশক্তিকে পরাস্ত করা, যারা চার্লিকে (কার্ক) আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।’
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থক ও ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (এমএজিএ) আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার থাকা লরা লুমার বলেন, ‘সরকারের উচিত সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে বামপন্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সহিংস প্রতিবাদে অর্থায়নকারী যেকোনো বামপন্থী সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনো দয়া দেখানোর সুযোগ নেই।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের মালিক এবং ধনকুবের ইলন মাস্ক আরও সরাসরি আক্রমণ করেছেন। এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘বামেরা হলো হত্যাকারীর দল।’
ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়মিত ‘চরম বামপন্থী উন্মাদ’ বলে আক্রমণ করেন। তাদের যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। ট্রাম্প বুধবারের গুলির ঘটনাকে অতিরিক্ত উসকানিমূলক বক্তব্যের ফলাফল বলেছেন।
নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘যাঁদের সঙ্গে মতভেদ আছে, তাঁদের দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়ভাবে শত্রু প্রতিপন্ন করার করুণ পরিণতিই হলো সহিংসতা ও হত্যা।’
ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক শান্ত ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এখনো জানি না, চার্লি কার্ককে গুলি করে হত্যার পেছনে উদ্দেশ্যটা কী। তবে আমাদের গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের ঘৃণ্য সহিংসতার কোনো স্থান নেই।’

চার্লি কার্কছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য গ্যাবি গিফর্ডস বলেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজে সব সময়ই রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু আমাদের কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি দেশ বানাতে দেওয়া চলবে না, যেখানে সহিংসতার মাধ্যমে মতবিরোধের সমাধান করা হয়।’
গ্যাবি গিফর্ডস ২০১২ সালে এক বন্দুকধারীর হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
অবশ্য ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের গভর্নর এবং ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী জেবি প্রিৎজকার অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি ট্রাম্পকে রাজনৈতিক সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য দায়ী করেছেন। সাংবাদিকদের প্রিৎজকার বলেন, ‘এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। আমার মনে হয়, এই দেশে কিছু মানুষ ইচ্ছা করে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য প্রায়ই এ ধরনের উসকানি জোগায়।’
মার্কিন নাগরিকেরা অবশ্য ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক সহিংসতার বিপক্ষে।
গত বছরের অক্টোবরে রয়টার্স/ইপসোস পরিচালিত এক জরিপে মার্কিন নাগরিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করতে অন্য দলের কাউকে হুমকি বা ভয় দেখানোকে তারা গ্রহণযোগ্য মনে করে কি না।’ মাত্র ৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, যা একেবারেই নগণ্য সংখ্যা।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুথ ব্রাউনস্টাইন কার্ক ডানপন্থী রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় আগে থেকে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে।
ব্রাউনস্টাইন বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে এটা অবশ্যই এক বিরাট ট্র্যাজেডি। তবে একই সঙ্গে এটি আগে থেকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশের উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা বাস্তবসম্মত আশঙ্কা এবং সত্যিকারের ঝুঁকি।’
বন্দুক সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠন ব্র্যাডির প্রধান নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা ক্রিশ্চিয়ান হেইনে দলগুলোকে আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে অভিন্ন সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান। ব্র্যাডির নামকরণ হয়েছে জেমস ব্র্যাডির নামে।
হোয়াইট হাউসের সাবেক এ প্রেস সেক্রেটারি ১৯৮১ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ওপর হত্যাচেষ্টার সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
হেইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট ব্লুস্কাই-এ লিখেছেন, ‘বন্দুক সহিংসতা দলীয় পরিচয় দেখে না। এটা নির্বিচার ঘটে। আর মার্কিন জনগণ সব সময়ই এই সহিংসতার ভুক্তভোগী। আমরা জানি পরিবর্তন সম্ভব। আমাদের এমন ভান করা বন্ধ করতে হবে যে এখানে আলাদা আলাদা পক্ষ আছে। বরং সবাই মিলে নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য লড়াই করতে হবে।’
একজন রিপাবলিকান নেতা উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেছেন। তিনি হলেন উত্তর ক্যারোলিনার সিনেটর টম টিলিস। তিনি বলেন, ‘কার্কের মৃত্যু নতুন সংঘাতের অজুহাত হতে পারে না। যারা শান্তভাবে আলোচনা করার বদলে সহিংস প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেয়, তারা কার্ক এবং অন্যদের মৃত্যুর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।’