যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের নিশানায় কারা, কী তাঁদের অপরাধ

চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বিভাগের কর্মকর্তারা শত শত শিক্ষার্থী ও সম্প্রতি স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের ভিসা বাতিল করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছেন।
এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনের সপক্ষে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। অন্যরা ভিসা বাতিল বা গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, এই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসগুলোতে ইহুদিবিরোধিতা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন শিক্ষার্থী, আইনজীবী ও অধিকারকর্মীরা। অথচ গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত অনেক বড় বিক্ষোভেই সম্মুখসারিতে ছিলেন ইহুদি অধিকারকর্মী ও বিভিন্ন সংগঠন।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, এই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসগুলোতে ইহুদিবিরোধিতা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন শিক্ষার্থী, আইনজীবী ও অধিকারকর্মীরা। অথচ গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত অনেক বড় বিক্ষোভেই সম্মুখসারিতে ছিলেন ইহুদি অধিকারকর্মী ও বিভিন্ন সংগঠন।
কোনো কোনো শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে আইন লঙ্ঘনের ছোটখাটো ঘটনায়, যেমন টিকিট বা ট্র্যাফিক–সংক্রান্ত নিয়মকানুন লঙ্ঘনের দায়ে।
কত শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে
গত মার্চের শেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, প্রশাসন প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে। তবে এ সংখ্যা তাঁর দেওয়া পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি।
এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের পরিসংখ্যানে পার্থক্য রয়েছে। ভিসা বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ সংখ্যার তথ্য দিয়েছে ‘আমেরিকান ইমিগ্রেশন ল ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন’। তাদের হিসাবমতে, মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট পরিচালিত ‘স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেমস (এসইভিআইএস)’ নামের তথ্যভান্ডার থেকে ৪ হাজার ৭০০–এর বেশি শিক্ষার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এমনকি অধিকতর রক্ষণশীল হিসাবেও এ সংখ্যা এক হাজারের বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারসের (এনএএফএসএ) অনুমান, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার হুমকির মুখে রয়েছেন ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থী।
আবার উচ্চশিক্ষা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রকাশনা ‘ইনসাইড হাইয়ার এড’–এর তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৯ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল হয়েছে।
ক্ষতির মুখে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ইনসাইড হাইয়ার এড বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ভিসা বাতিলের শিকার হয়েছেন।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের মতো বৃহৎ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। রয়েছে কিছু ছোট লিবারেল আর্টস কলেজও।
এমন ঢালাও পদক্ষেপ (ভিসা বাতিল ও গ্রেপ্তার) নানা আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং এতে সঠিক প্রক্রিয়া (ভিসা বাতিল) ও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
মোহাম্মদ আলী সাইদ, অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি সংগঠনের কর্মকর্তা
ভিসা বাতিল কেন করা হলো ও এর বিকল্প কী
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, তারা ক্যাম্পাসগুলো অধিকারকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে।
গত ২৮ মার্চ রুবিও বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রে অধিকারকর্মী আমদানি করতে চাই না। তাঁরা (শিক্ষার্থীরা) এখানে পড়তে আসেন। তাঁরা এখানে আছেন ক্লাসে যাওয়ার জন্য। অ্যাক্টিভিস্টদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁরা এখানে থাকেন না। এসব আন্দোলন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম বিঘ্নিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে এভাবে বন্ধন সৃষ্টি করেন বিক্ষোভকারী এ শিক্ষার্থীরা। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, সেন্ট লুইস, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪
তবে অনেক শিক্ষার্থী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের থাকার বৈধ অনুমতি কোনো নেটিশ ছাড়াই বাতিল করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন মাহমুদ খলিল, মোহসেন মাহদাওয়ি ও মোমোদু তায়ালের মতো শিক্ষার্থীরা। তাঁরা ক্যাম্পাসগুলোতে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ চলার সময় এর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন।
যাহোক, অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি সংগঠনের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সাইদ বলেন, অন্য শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে অতীতে ট্রাফিক–সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের কারণে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিসা বাতিলের কারণ হিসেবে কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই।
আলী সাইদ বলেন, ‘এমন ঢালাও পদক্ষেপ নানা আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং এতে সঠিক প্রক্রিয়া (ভিসা বাতিল) ও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।’ প্রশাসনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার পেতে এবং নিজেদের অধিকারের সুরক্ষায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে অভিবাসন আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
আলী সাইদ আরও বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার বিষয়টি উল্লেখ করে ও আইনি বৈধতা ফিরে পেতে শিক্ষার্থীরা ফেডারেল আদালতগুলোতে মামলা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিরুদ্ধে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা যায়। মামলায় তাঁরা অভিযোগ করেছেন, যথাযথ নোটিশ বা ব্যাখ্যা না দিয়ে তাঁদের এফ-ওয়ান স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’
কত শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল হয়েছে, তা নিয়ে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য রয়েছে। এমন শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ সংখ্যা জানিয়েছে ‘আমেরিকান ইমিগ্রেশন ল ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন’। তাদের হিসাবমতে, মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট পরিচালিত ‘স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেমস (এসইভিআইএস)’ নামের তথ্যভান্ডার থেকে ৪ হাজার ৭০০–এর বেশি শিক্ষার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
‘জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষার্থীরা তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে সাময়িক স্থগিতাদেশ ও আইনি পদক্ষেপের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের বৈধ মর্যাদা পুনর্বহালের অনুরোধ জানাতে পারেন,’ বলেন এই কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক বিতাড়ন ঠেকাতে মন্টানার মতো অঙ্গরাজ্যগুলোতে ফেডারেল বিচারকদের আদেশ প্রদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
সাইদ আরও বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনগত সহায়তা দিয়ে, ফেডারেল কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াচ্ছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির কথা বলেন।
হাফসা কাঞ্জওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের লাফায়েট কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক। ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করার কী প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থী ও ফ্যাকাল্টি সদস্য—উভয়ের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে যাওয়ার কথা দুবার ভাবছেন, এ আশঙ্কায় যে তাঁদের হয়তো বাইরে থেকে ফিরতে দেওয়া হবে না।

মুঠোফোন উঁচিয়ে আলো জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ফ্যাকাল্টি সদস্য বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভয়ের মধ্যে আছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্ত করেননি, তাঁদের অনেকেই নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রোফাইল মুছে ফেলছেন। তাঁরা এ ভেবে আতঙ্কিত যে নিজেদের কোনো পোস্ট বা বক্তব্য ধরে তাঁদের গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে। এতে তাঁদের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যাবে।’