Bangladesh

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের আঞ্চলিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাপী জোটবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভারসাম্যতা-টানাপোড়ন-ক্ষমতায়নের মোড়কে সৃষ্ট নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণ দৃশ্যমান। প্রভাব বলয়, আস্থা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সন্দেহের নবতর অধ্যায় নির্মিত হচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন কংগ্রেসম্যান এড কেইস ও রিচার্ড ম্যাককরমিক বাংলাদেশ সফরে এসে মন্ত্রী-এমপি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে যে আলোচনা করেছেন, সেখানে ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গুরুত্ব পেয়েছে। আমেরিকা চায়, ঢাকায় গণতান্ত্রিক সরকার সমুন্নত থাকুক। ওয়াশিংটনের অবস্থান বিশ্বের পশ্চিম প্রান্তে হলেও তারা পূর্ব প্রান্তের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোতে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র দেখতে চায়। মূলত বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে চীনকে মোকাবিলা করতেই যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতিগত আচরণ। বাংলাদেশকেও শতভাগ পাশে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ হিসাবে বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এরই মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমারে এবং দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানে চীন তার অবস্থান নিশ্চিত করায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার অবস্থান নিশ্চিতের তৎপরতা চালাচ্ছে। এ কারণে চলমান সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ঘন ঘন ঢাকা সফর করছেন। বিজ্ঞমহলের মতে, এর মূল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং চীনকে ঠেকানো।

বিশ্লেষকদের দাবি, বিশ্ব অর্থনীতি-রাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলমান। ভবিষ্যতে চীন পুরো বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নড়বড়ে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সেটা করতে গেলে তাকে মিত্র জোগাড় করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাষ্ট্র হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ঠিক সেভাবেই এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অপেক্ষাকৃত গরিব ও কম শক্তিশালী দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে চীন তার নিজের শিবিরে টানার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর অংশ হিসাবে সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামক প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে, যা ২০৪৯ সালে শেষ হবে। এ প্রকল্পের সঙ্গে ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্তত ৬৮টি দেশ যুক্ত হয়েছে।

গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ইন্দো-প্যাসিফিক ভাবনা তুলে ধরে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার কূটনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র, ভারত-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এ অঞ্চলের কোনো দেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হোক, তা যুক্তরাষ্ট্র চায় না। যুক্তরাষ্ট্র নেপালকে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনে (এমসিসি) অন্তর্ভুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এটি এমসিসি ইন্দো-পলিসি নীতির অংশ। এর মাধ্যমে আসলে নেপালকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতার মধ্যে টেনে আনা হয়েছে। এ অঞ্চলে চীনকে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। চীন নিয়ে জোরালো অবস্থান নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।’

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত নিগূঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন এতটাই মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে তা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসাবে প্রতিভাত। বিশেষ করে উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা-মেধা-দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বের ঊর্ধ্বে। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অধিক শক্তিশালী হলেও ভারত ও চীন উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক-সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক। আঞ্চলিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ বরাবরই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের উৎস বিবেচনায় ভারত অন্যতম সহযোগী প্রতিবেশী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ট্রানজিট সুবিধা, ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সম্মতি, বাংলাদেশ কর্তৃক ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং ভারত কর্তৃক এক মিলিয়ন ডলার ঋণদান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মেলবন্ধনকে সুদৃঢ় করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে বিবেচনা করলেও বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বড় কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তারের আলোকে এ বিষয়ে ভারতের মনোযোগ অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখতে পাই-১৯৭২ সালের আগস্টে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানকালে ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র চীন তাদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সেই চীন এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় বাণিজ্য সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান। নিবিড় রাজনৈতিক-সামরিক সম্পর্কের পাশাপাশি চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগী। করোনা মহামারি-পরবর্তী চীনের ‘হেলথ সিল্ক রোড’ প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সহযোগিতার বিশাল দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২৭টি প্রকল্প নিয়ে ‘বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা জোরদারকরণ’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

গত ৩১ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে ছোট, বড় ও মাঝারি অন্তত ২৫টি চীনা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ধরনের ৯টি বৃহৎ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ৮৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায়। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাঁশখালী ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার অ্যান্ড পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক, ঢাকেশ্বরী সুয়্যারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ডেভেলপমেন্ট অব আইসিটি ইন্ট্রা নেটওয়ার্ক ফর ফেজ-২৫, অষ্টম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ। এছাড়াও যোগাযোগ, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও শিক্ষা খাতের বিপুলসংখ্যক প্রকল্পে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।

চীনের সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণও অনেক। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে দুই বছরে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করা সাতটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষ পাঁচটিই ছিল চীনের। ওই বছরগুলোয় ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৫৯ কোটি ডলারেরও বেশি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না ঋণ দিয়েছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৪০ কোটি ডলার। চায়না-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের মুখপাত্র গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীনের বিশাল এ বিনিয়োগ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশকে এক অনন্য সুবিধা এনে দেওয়া সম্ভব হবে। এখানে চীনা বিনিয়োগের যে প্রবাহ তা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসাবে বিকাশ ঘটাতে পারবে। আর চীনা প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতেও এগিয়ে যাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ারই হলো প্রযুক্তি। ফলে আগামী এক দশকে যারা প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিধর হবে, তারাই বিশ্ব শাসন করবে। আর এখানে চীন ১ হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে আগে থেকেই এগিয়ে আছে।’

সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করা, চীনের দেওয়া ঋণের সুদহার ১ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি উত্থাপন করলে সেটি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাসও ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া বাংলদেশের উন্নয়নে নতুন নতুন সেক্টরে চীনের কাজ করার আগ্রহ প্রকাশও আশাব্যঞ্জক। মোদ্দ কথা, সার্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে চীনের সহযোগিতা অত্যন্ত ইতিবাচক। রোহিঙ্গা সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে চীনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই তা যুগান্তকারী মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসাবে উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে কোনো কর্তৃত্ববাদী শক্তির কাছে মাথানত না করে স্বকীয় পন্থা ও উদ্যোগে এগিয়ে যাবে-এটিই প্রত্যাশিত।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button