যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক জৈব জ্বালানি জোটে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ
এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোনো জোটে যোগ দেওয়ার প্রথম ঘটনা, যা অভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদানের সহযোগী হবে।
জৈব জ্বালানির বৈশ্বিক জোট – গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স (জিবিএ)-তে যোগ দিতে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। ওয়াশিংটন ও দিল্লির নেতৃত্বাধীন এ জোটের লক্ষ্য – জৈব জ্বালানির ব্যবহার রপ্ত করতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো।
ইতোমধ্যেই এ জোটের স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে– ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভারতের এ প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ। ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোন জোটের সদস্য নয় বাংলাদেশ। জৈব জ্বালানির বৈশ্বিক জোটটিতে বাংলাদেশ যোগ দিলে, তা হবে প্রথম এ ধরনের জোটে যোগদানের ঘটনা; যা অভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদানের সহযোগী হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে, এ জোটে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নবম নিরাপত্তা সংলাপ শেষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিরা দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত মতবিনিময়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
“তারা (যুক্তরাষ্ট্র) চায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক যেন আরও গভীরতর হয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক—সব দিকেই। আমরা বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বহুমুখী সম্পর্কে কোনো দূরত্ব যেন তৈরি নাহয়, সেজন্য নিয়মিত বৈঠক হওয়া দরকার”- বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈব জ্বালানি নিয়ে বৈশ্বিক একটি জোট হলে, সেখানে বাংলাদেশের সদস্য হতে কোনো সমস্যা নেই।
পরিবহন, হিটিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন-সহ বিভিন্ন কাজে জৈব উৎস থেকে উৎপাদিত বায়োফুয়েল জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। জৈব জ্বালানিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির একটি উৎস বলেও মনে করা হয়।
২০১৭ সালে সরকার একটি জৈব জ্বালানি নীতি গ্রহণ করে। এর আওতায়, পেট্রোল ও অকটেনের সঙ্গে ৫ শতাংশ বা সরকার অনুমোদিত যেকোনো অনুপাতে– বায়ো-ইথানল মিশ্রণ করে যানবাহনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত রয়েছে ।
আমদানি করা ভুট্টা শস্য, গুড়, পুরনো নিউজ পেপার, তুষ, ভুট্টার গাছ, আখের ছোবরা, বাতিল সুতা ও তুলা, ধানের খড়, গাছের বাকল, সবজির পরিত্যক্ত অংশ এবং কচুরিপানা ইত্যাদিকে ইথানলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ উদ্যোগকে সহযোগিতা দিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বায়ো-ইথানল উৎপাদন, প্ল্যান্ট স্থাপন ও ব্যবহারের একটি পরিকল্পনাও প্রণয়ন করে। কিন্তু, এখাতে উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ হয়নি।
প্রস্তাবে যা আছে
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০২৩ সালে মে মাসে ভারতের পেট্রোলিয়াম ও ন্যাচারাল গ্যাস-মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে এবিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি দেন।
এরপর গত ২২ জুলাই গোয়া’য় বৈশ্বিক জৈব জ্বালানি জোটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে ভারত।
এই অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, ভারত, ইতালি, কেনিয়া, মরিশাস, প্যারাগুয়ে, সিশেলস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা ও যুক্তরাষ্ট্র-সহ এক ডজনের বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে। নয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরাও এতে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের আগে– গত ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে এ জোটে যোগদানের ভারতীয় প্রস্তাবের ওপর মতামত চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের হাই-কমিশন-ও এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র দপ্তর ও জ্বালানি বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছে।
জি-২০ এনার্জি ট্রানজিশন গ্রুপের একটি বিশেষজ্ঞ দল এ জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন নথি নিয়ে আলোচনা করছে। এ নথি স্বাক্ষরে বাংলাদেশের সমর্থন চাওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
নসরুল হামিদকে পাঠানো নোট ভারবালে হাই-কমিশন বলেছে, জি-২০’র বর্তমান সভাপতি হিসেবে ভারত জি-২০’র কাছে এই জোটের স্বীকৃতি চায়, এবং বাংলাদেশকে এর একটি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
জিবিএ’র প্রতিষ্ঠাকালীন নথি অনুসারে, বিশ্বব্যাপী টেকসই জৈব জ্বালানির উন্নয়ন ও ব্যবহারকে সমর্থন করবে এই জোট। একইসঙ্গে, জাতীয় পর্যায়ের জৈব জ্বালানি কর্মসূচিতে কারিগরি সহায়তা দেবে, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করবে এবং বায়োফুয়েল ভ্যালু চেইনের সর্বস্তরে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে সহায়তা দেবে। জৈব জ্বালানির বিষয়ে জনমনের বিভিন্ন ভুল ধারণার অবসান ও তা পরিবর্তনের চেষ্টার পাশাপাশি এর বৈশ্বিক বাণিজ্যকে জোরদার করবে।
জিবিএ কার্যকরভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, এবং টেকসইভাবে ফিডস্টক ব্যবহার, টেকসই জৈব জ্বালানির সরবরাহ এবং প্রাপ্যতা সুরক্ষিত করার জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনের বিনিময়কে উৎসাহিত করবে।
নথি অনুসারে, এই জোটের সদস্য দেশ, অংশীদার সংস্থা ও শিল্পকে একত্রিত করার জন্য তিন-শ্রেণির সদস্য কাঠামো থাকবে।
বিশ্বের ইথানল উৎপাদনের ৮৫ শতাংশই হয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং ভারতে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ৫৫ শতাংশ। তারপরে ব্রাজিল ২৭ শতাংশ এবং ভারত ৩ শতাংশ উৎপাদন করে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) সংস্থার একটি হিসাবমতে, নেট জিরো পরিস্থিতিতে- তরল ও বায়বীয় জ্বালানিতে তরল বা বায়বীয় জৈব জ্বালানির মিশ্রণের অনুপাত- বর্তমানের ১.৬ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫.৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বর্তমানে ভারতের সব জ্বালানি পাম্প ১০ শতাংশ ইথানল (ই-১০) মিশ্রিত পেট্রোল বিক্রি করে। ২০২২ নভেম্বর নাগাদ পেট্রোলে ১০ শতাংশ ইথানল মিশ্রণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ভারতের, কিন্তু তার আগেই ওই বছরের জুন মাসে তা অর্জন করে। এখন ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ দেশব্যাপী ই-২০ পেট্রোল চালুর লক্ষ্য নিয়েছে ভারত।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম টিবিএসকে বলেন, জৈব জ্বালানির জন্য কোনো বৈশ্বিক জোট হলে, তাতে বাংলাদেশের যোগদানে কোনো সমস্যা নেই। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে হবে। জৈব জ্বালানি উৎপাদন যেন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত না করে, সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সাধারণত ভুট্টা দিয়ে বায়োফুয়েল উৎপাদন করা হয়। ব্রাজিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের এক্ষেত্রে অনেক সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের কৃষিজমি কম এবং জমির স্বল্পতা থাকায়– বায়োফুয়েল উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ কম।’
‘গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স গঠনের সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির কোন সম্পর্ক আছে কি-না, তা জানি না। যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোতে নানানভাবে ঢুকতে চেষ্টা করছে। কখনও আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে, কখনও সামরিক সহায়তা দিয়ে। এই জোটের (জিবিএ) প্রধান তিন স্বাক্ষরকারীর – মধ্যে ভারত ও ব্রাজিল – উভয়ই ব্রিকসের সদস্য’ – যোগ করেন তিনি।
সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হাসান বলেন, জিবিএ জোটে ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশের উপস্থিতি থাকায়– বাংলাদেশের সদস্য হওয়া সুফল বয়ে আনতে পারে।