Bangladesh

যেন ঠকবাজের হাট

সবুজ মাল আর দুলাল মাল সহোদর। দু’জনই ছিলেন জেলে। ২০১৮ সালের দিকে ঠকবাজিতে নাম লিখিয়ে এখন তারা টাকাওয়ালা। প্রতারণার টাকায় কিনেছেন এক একর জমি। হয়েছে পাকা বাড়ি আর গরুর খামার। 

কৃষকপুত্র রুবেল-জুয়েল। একই কায়দায় এ দুই ভাইও নীরবে ধনী। ‘বায়বীয়’ টাকায় গেল পাঁচ বছরে কিনেছেন অন্তত আট একর জমি। স্থানীয় বাজারে ১২ শতাংশ জমির ওপর উঠেছে সাত-সাতটি দোকান। ১০ পুকুরে মাছ আর গোয়ালভরা গরু। তাদের চাচাতো ভাই মামুন হাওলাদারও প্রতারণার পথে কম যাননি। তাঁরও রয়েছে মাছের ঘের, গরুর খামার।

কৃষক আবদুল লতিফের দুই ছেলে মাসুদ আর মিরাজ। মাসুদ কাঠমিস্ত্রি, মিরাজ ছিলেন রাজমিস্ত্রির জোগালি। ২০১০ সালের দিকে প্রতারণার খাতা খুলে বদলে ফেলেন ‘দরিদ্র জীবন’। এখন এলাকার অন্তত আট একর জমি তাদের। এর মধ্যে দুই একর জমিতে সুপারি বাগিচা।

সিরাজ মাতুব্বর লোহা পিটিয়ে সোজা পথে চলেছেন জীবনের অনেকটা সময়। ২০১৪ সালের দিকে ধোঁকাবাজি রপ্ত করে টানলেন ‘কামার’ অধ্যায়ের ইতি। কামার জীবনে ছিলেন রিক্ত, এখন তিনি কোটিপতি। স্থানীয় বাজারে উঠেছে তিনতলা দালান, কিনেছেন বিপুল পরিমাণ জমি।

এভাবেই ভোলার বোরহানউদ্দিনের কাচিয়া ইউনিয়নের অনেক মানুষ আসল পেশা ছেড়ে জড়িয়েছেন শঠতায়। তারা ‘টাকার গাছ’ বানিয়েছেন বিপদগ্রস্ত মানুষকে ঠকিয়ে। কখনও ‘জিনের বাদশা’, কখনও ‘দরবেশ বাবা’ সেজে অসহায় মানুষের সমস্যা সমাধানের পথ দেখানোর কথা বলে দু’হাতে কামিয়েছেন টাকা। প্রতারণার টাকায় কোটিপতি হয়েছে এমন অর্ধশত ঠকবাজের তথ্য পেয়েছে সমকাল।
কাচিয়া ইউনিয়নে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের বাস। ৯ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে আছে ‘দরবেশ বাবা’ প্রতারক চক্রের ছায়া। দুষ্টচক্রের এমন অপকীর্তিতে কাচিয়ার নামই হয়ে গেছে ‘জিনের বাদশা’ ইউনিয়ন! ঠকবাজদের যন্ত্রণায় এলাকার মানুষ ত্যক্তবিরক্ত। তাদের দুষ্কর্মে কাচিয়া ইউনিয়নের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে দাবি করে প্রতারকমুক্ত ইউনিয়ন চান তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতারক ধরতে মাঝেমধ্যেই গ্রামে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চক্রের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের একই কাজে নামে প্রতারকরা।

যেভাবে প্রতারণা
চক্রের সদস্যরা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে দুই কৌশলে। এক. গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। লটারি পাইয়ে দেওয়া, ভাগ্যবদল, পাওনা টাকা আদায়, মামলায় জেতানো, অর্থ সংকট দূরসহ সব সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয় বিজ্ঞাপনে। বলা হয়– আধ্যাত্মিক ও তান্ত্রিক ক্ষমতাবলে বিপদগ্রস্ত মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। এরপর বিজ্ঞাপনে থাকা মোবাইল ফোন নম্বরে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি যোগাযোগ করলে শুরু হয় পকেট কাটা। দুই. চক্রের সদস্যরা নিজে থেকেই মানুষের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে গভীর রাতে কিংবা ভোরে মানুষকে ফোন করে ‘জিনের বাদশা’ হিসেবে পরিচয় দেয়। ধনসম্পত্তির জটিলতা, সংসারে অশান্তি দূর করাসহ সব মুশকিল আসানের টোপ দেয় তারা। টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে কখনও কখনও কথা বলে নারী বা ক্ষীণ কণ্ঠে। কাউকে ফাঁদে ফেলতে পারলে চক্রের সদস্যরা প্রথমে শুরু করে হাজার টাকা দিয়ে। পরে ধাপে ধাপে নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়।

শেখ সাদী দিয়ে শুরু
সময়টা ২০০৫ সাল। বোরহানউদ্দিনের কাচিয়া ইউনিয়নের ফুলকাচিয়া গ্রামের শেখ সাদী এলাকায় প্রথম ‘জিনের বাদশা’ নামে প্রতারণার আবির্ভাব ঘটান। বিপদগ্রস্ত মানুষের সব মুশকিল আসানের কথা বলে দিতেন বিভিন্ন পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন, মোড়ে মোড়ে সাঁটাতেন পোস্টার। প্রলুব্ধ হয়ে ইউনিয়নের অনেকে তাঁর প্রতারণার জালে আটকা পড়েন। অনেকে আবার শেখ সাদীর চক্রে ভেড়েন। এলাকায় ‘প্রতারণার হাট’ খুলে দীর্ঘদিন ধরেই শেখ সাদী ঢাকায় খুঁটি গেড়েছেন। রাজধানীতে তিনি কোথায় থাকেন– সে তথ্য এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা। তাঁকে দীর্ঘদিন হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
ফুলকাচিয়া গ্রামের ৩৫ পেরোনো আনোয়ার পাটোয়ারী ডিঙাতে পারেননি প্রাথমিকের গণ্ডি। ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ২০১২ সালে রাজমিস্ত্রির পেশা ছেড়ে নামেন ‘রাজা’ হওয়ার ধান্দায়। শেখ সাদীর চক্রে যুক্ত হয়ে ‘জিনের বাদশা’ সেজে রাতারাতি কোটিপতিও বনে যান আনোয়ার। টিনের ঘর থেকে এখন অভিজাত বাড়িতে তাঁর বাস। কিনেছেন অন্তত পাঁচ একর চাষের জমি। তাঁর নামে রয়েছে প্রতারণার মামলা।

একই গ্রামের শাহে আলম রাঢ়ীর ছেলে আলামিন এক যুগ আগেও ছিলেন মিজির বাজারের চা দোকানি। পরে ঠকবাজির অবৈধ টাকায় কিনেছেন ট্রাক, দেড় একর জমি ও দোকান। একাধিক প্রতারণা মামলার আসামিও তিনি। এক দশক আগে প্রতারণায় নেমে পিছিয়ে নেই এক সময়ের রিকশাচালক শাহ আলম মুন্সির ছেলে আওলাদ মুন্সিও। এক সময় খড়ের ছাউনির ঘর ছিল। পরে গ্রামে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচা করে বাড়ি করেছেন। কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমি। আওলাদও একাধিক মামলার আসামি।

চক্রের চক্রান্ত যেভাবে
ঢাকার শ্যামপুরের ব্যবসায়ী সোহাগ শরীফ একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী মো. কালামকে ব্যবসায়িক কাজে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরে কালাম টাকা ফেরত না দিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। এক রাতে একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় সোহাগের। বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়– জাকির কবিরাজ নামে এক ব্যক্তি ভাগ্যবদল, পাওনা টাকা আদায়, আর্থিক সংকট দূর করাসহ সব ঝামেলাপূর্ণ কাজ সমাধান করে দেবেন। পরে সোহাগ যোগাযোগ করেন কবিরাজের সঙ্গে। অন্য প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে মাইনুল কবিরাজ এবং জিন নিয়ন্ত্রণকারী পরিচয় দিয়ে টাকা আদায় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘তন্ত্রমন্ত্র’র কাজে ব্যবহারের জন্য সোহাগের কাছ থেকে কবিরাজ প্রথমে ২৫ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে নেন। পরে আরও ২৪ হাজার ৯৭০ টাকা নেন। এভাবে সোহাগের কাছ থেকে আট লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতায় ওই চক্র। ফাঁদে পড়েছেন টের পেয়ে সোহাগ টাকা ফেরত চাইলে বেঁকে বসে জিন নিয়ন্ত্রণকারী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি। এরপর অচেনা নম্বর থেকে ‘জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়ে তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে ‘বানটোনা’ করে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। হুমকি দিয়ে আরও তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। দেখা করার উদ্দেশ্যে তাদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গত ৬ ডিসেম্বর ভোলার বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জেরহাট বাজারে যান সোহাগ। পরে সেখানে গিয়ে সোহাগ চক্রের কাউকে পাননি। এরপর পুলিশের কাছে যান তিনি। তদন্তে বেরিয়ে আসে– জিনের বাদশা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা কাচিয়া ইউনিয়নের ফুলকাচিয়া ও চকডোষ গ্রামের বাসিন্দা। তারা হলেন ইলিয়াস, নুর আলম, মো. রফিক, আলাউদ্দিন, শেখ ফরিদ, মো. হাসান, শাহাবুদ্দীন ও মো. শহীদ। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী সোহাগ ৭ ডিসেম্বর বোরহানউদ্দিন থানায় মামলা করেন।

মামলাটির আসামি ফুলকাচিয়ার ২৫ বছরের ইলিয়াসের বাবা ইউনুস কুঞ্জেরহাট বাজারে আমড়া বেচতেন। ইলিয়াস পানের বরজে দিনমজুরির কাজ করতেন। বছর চারেক আগে তিনি ‘জিনের বাদশা’ চক্রে নাম লেখান। এরই মধ্যে কুঞ্জেরহাট বাজারে জুতার দোকান দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এলাকায় প্রায় ৫০ লাখ টাকায় জমি কিনেছেন। আরেক আসামি নুর আলমের বাড়ি ফুলকাচিয়ায়। তিনি এক সময় নছিমন চালাতেন। ২০১৫ সালে জিনের বাদশা চক্রে ঢোকার পর নছিমন ছাড়েন। এরপর কয়েক বছরেই কোটিপতি।

প্রতারিতরাও হতভম্ব
বিভিন্ন জেলার শত শত মানুষ এ চক্রের ফাঁদে পড়ে টাকা খুইয়েছেন। ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে কয়েক ধাপে ফুলকাচিয়া গ্রামের প্রতারক মো. হাসেম ও তাঁর সহযোগী তানজিল আহমেদ ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে রেকর্ড সাত কোটি টাকা খসিয়েছেন! ভুক্তভোগী আনোয়ারা বেগম জানান, পারিবারিক সমস্যা থাকায় মুক্তির পথ খুঁজছিলেন তিনি। একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন তিনি। অন্য প্রান্তে থাকা ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে হাসেম পারিবারিক সমস্যা দূর করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর ধাপে ধাপে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত সেপ্টেম্বের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের গ্রেপ্তার করে।

আনোয়ারা বেগম বলেন, ধারদেনা করে টাকা দিয়েছিলাম। জমি বিক্রি করে কিছু টাকা শোধ করেছি। এখনও ৪০ লাখ টাকা ঋণ আছে। তবে প্রতারকদের কাছ থেকে এক টাকাও ফেরত পাইনি। আদৌ ফেরত পাব কিনা জানি না।

প্রতারণার শিকার ঢাকার শ্যামপুরের ব্যবসায়ী সোহাগ শরীফ বলেন, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখে পাওনা টাকা উদ্ধারের প্রত্যাশায় যোগাযোগ করেছিলাম। তারা জিন নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানিয়েছিল। এরপর ফাঁদে ফেলে আমার কাছ থেকে ১১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়েছে।

প্রতারণার শিকার হয়ে চট্টগ্রামের মাসুদা আক্তার গত ১৭ এপ্রিল বোরহানউদ্দিন থানায় মামলা করেন। তিনি জানান, তাঁর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। সুসম্পর্ক করানোর উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞাপন দেখে একটি নম্বরে ফোন দেন। অন্য প্রান্তের ব্যক্তি সমস্যা সমাধানের কথা বলে ধাপে ধাপে মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ফেনীর ফাহাদ ভূঁইয়া জানান, বিদেশে ১২ কোটি টাকা লটারি জেতার জন্য তাঁর মামা ফ্রান্সপ্রবাসী ইমাম হোসেন ‘জিনের বাদশা’ চক্রকে দেড় কোটি টাকা দিয়েছেন। পরে লটারি জিততে না পেরে চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এরপর ফেনী সদর থানায় মামলা করেন তারা।

কে কী বলছেন
কাচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রব কাজী বলেন, প্রতারকরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে একই কাজ করছে। এ প্রতারণা দিন দিন বাড়ছে। এ ব্যাপারে পুলিশকে আরও শক্ত হাতে কাজ করতে হবে।
বোরহানউদ্দিন থানার ওসি শাহীন ফকির সমকালকে বলেন, কাচিয়া ইউনিয়নে জিনের প্রতারণার কারবার অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ প্রতারণার শিকার হয়ে এখানে টাকা উদ্ধারের জন্য আসেন। প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ভোলা জেলা পুলিশের সাইবার ইউনিট, ডিবি, ঢাকার সিআইডি ও র‍্যাব যৌথভাবে এ চক্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button