Hot

যেভাবে ‘প্রিন্স’ হয়ে ওঠেন ডিবি হারুন

ক্ষমতার গরমে উড়তেন সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশীদ। তাঁর ওপরের কর্মকর্তাদেরও তাঁকে সমীহ করে চলতে হতো। কখনোই চাকরি বিধিমালার তোয়াক্কা করতেন না। জড়িয়েছেন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। বাড়ি ও জমি কেনা নেশা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, রিসোর্ট কী নেই তাঁর? ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেওয়া থেকে আরো অসংখ্য অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু কখনো এর বিচার হয়নি। উল্টো মিলেছে পুরস্কার।

ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করাও ছিল তাঁর আরেক নেশা। সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে প্রথমেই এসেছিলেন লাইম লাইটে।

জানা যায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আসার সময় তাঁর দপ্তরে ‘প্রিন্স’ আসছেন বলে শোরগোল শুরু হতো। এমনকি তিনি মন্ত্রীর রুমে ঢোকার সময় আগে থেকে দরজাও খুলে রাখা হতো।

গতকাল রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সচিবালয়ের ৮ নম্বর ভবনে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এলে আগে থেকেই হারুনের জন্য লিফট আটকে রাখা হতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে তাঁকে সমীহ করে চলতে হতো ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদেরও। এমনকি ডিএমপি কমিশনার তাঁর ওপরের বস হলেও তাঁর কথাও তিনি শুনতেন না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, হারুন আসার পর যাঁরা সামনে পড়তেন তাঁরা তাঁকে সালাম দিতেন। কিন্তু তিনি সালামের উত্তর দিতেন না।

এমন অহমিকা ছিল তাঁর।
 
হারুন কোথায়?

পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ কোথায়? এ প্রশ্ন সবার। কিন্তু নিশ্চিত কোনো তথ্য কেউ দিতে পারছেন না। কেউ বলছেন তিনি দেশে পালিয়ে আছেন। কেউ বলছেন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি জানতে চাইলে কেউই নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি। একটি সূত্রের দাবি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মতো হারুনও বিদেশে চলে গেছেন। হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে আর হারুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। 

যত অবৈধ সম্পত্তি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এহেন অপরাধ নেই যার সঙ্গে হারুনের হাত ছিল না। তিনি যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখান থেকেই কাঁরি কাঁরি টাকা কামাই করেছেন। জমি দখল, বাড়ি দখল, প্লট দখল, ফ্ল্যাট দখল ছিল তাঁর নেশা। গুম, খুন, হত্যা, অর্থপাচারেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হারুনের মাসিক বেতন ৮০ হাজার টাকার মতো হলেও তাঁর দেশে- বিদেশে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। একটি সূত্রের দাবি, কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর স্ত্রীর নামে একটি ব্যাংকে থাকা এক হাজার ৫৩২ কোটি টাকা এফবিআইয়ের সুপারিশে আটকা পড়েছে। সে টাকা উদ্ধার করতে পারেননি হারুন।

জানা যায়, শুধু রাজধানী ঢাকায়ই তাঁর আলিশান বাড়ি রয়েছে ২০টির বেশি। রয়েছে তিনটি রিসোর্ট। একাধিক আবাসিক হোটেলও রয়েছে। আরো ১০টি কম্পানির মালিকও তিনি। জানা গেছে, তাঁর কথিত মামা জাহাঙ্গীর আলমের নামে গড়েছেন এসব সম্পদ। দখল করা সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা দেশের বাইরেও পাচার করেছেন। বিদেশে অর্থপাচারের সুবিধার জন্য পুরানা পল্টনের একটি ভবনে তাঁর মানি এক্সচেঞ্জ ছিল বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, হারুনের স্ত্রী ২০০৭ সালের দিকে ডিবি ভিসায় আমেরিকায় পাড়ি জমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও রয়েছে হারুনের। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থে হারুনের পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। জানা গেছে, দুবাইয়ে একটি পাঁচতারা হোটেল এবং একজন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনারের ভাইয়ের সঙ্গে দুবাইয়ে হারুনের স্বর্ণের ব্যবসাও রয়েছে। তাঁর মামা জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে সৌদি আরবের জেদ্দায় একটি আবাসিক হোটেলে বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

সূত্র মতে, তাঁর স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় একটি বাড়ি কিনে দিয়েছেন হারুন। ওই সময় হারুনের স্ত্রীর বিপুল অর্থ লেনদেন শনাক্ত করে এর তদন্ত করেছিল এফবিআই। রাজধানীর উত্তরায় ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে (লেকপারের রোডে) একটি আট ও ছয়তলা বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। ছয়তলা বাড়িটি এটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছয়তলা বাড়িটির চতুর্থ তলায় হারুন থাকতেন। তাঁর স্ত্রী আমেরিকা থেকে এসে ওই বাড়িতেই উঠতেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট  রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তিনি আর ওই বাড়িতে থাকছেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যরা এরই মধ্যে আমেরিকায় চলে গেছেন। জানা গেছে, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ১০ কাঠা জমির ওপর হারুনের শ্বশুরের নামে একটি ১০ তলা মার্কেট রয়েছে। ১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটটির মালিক হারুন। এখানে তাজ ফুডকোর্টসহ কয়েকটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। একই সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি প্লট জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। এ ছাড়া ৩ নম্বর সেক্টরে ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন, ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ছয়তলা ভবন, ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে সাত কাঠার বাণিজ্যিক প্লট, ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাঁচ কাঠার একটি প্লট এবং ৫ নম্বর সেক্টরে ৬ নম্বর রোডে ঢুকতেই প্রথমে ২৯ ও ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠার দুটি প্লটের মালিক হারুন বলে জানা গেছে। এরই মধ্য সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হয়েছে, উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১৭ ও ১৯ নম্বর প্লট চারটি কম্পানির শো রুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির পাঁচ তলায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস। এই অফিসেই হারুনের সব সম্পত্তির কাগজপত্র রক্ষিত থাকে বলে জানিয়েছে জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সূত্র।

উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে পাঁচ কাঠার আরেকটি প্লট ‘স্টার কার সিলেকশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া আছে। এ ছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টর, জম টাওয়ারের পাশে, উত্তরা থার্ড ফেইজে, পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুনের।

শুধু উত্তরায় নয়, বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন। টঙ্গীর ২৭ মৌজায় আট বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে ‘জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর অশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল।

হারুন অর রশীদের নামে কিশোরগঞ্জে মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। গাজীপুরে রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং ‘গ্রিন টেক’ নামে আরো একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার। এ ছাড়া নন্দন পার্কেও শেয়ার আছে হারুনের। আছে আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কম্পানিতে বিনিয়োগ। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টের যৌথ ব্যবসা আছে হারুনের।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হারুন যা করেছেন তা কোনো পুলিশ কর্মকর্তা করতে পারেন না। তিনি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করতেন। এখন হাজার হাজার কোটি টাকার খবর বেরোচ্ছে। তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’

দুদকের অনুসন্ধান শুরু

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে হারুনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। দুদকের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের পরই হারুন ও তাঁর স্ত্রী শিরিন আক্তারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d